জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে দুটি বিভাগ গঠন করেছে সরকার। সোমবার রাতে এ-সংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারি করা হয়। সরকারের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে এনবিআর কর্মকর্তাদের সংগঠন এনবিআর ঐক্য পরিষদ তিন দিনের কলম বিরতির কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। তবে এ বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, এতে কর্মকর্তাদের দুশ্চিন্তার কারণ নেই। আর সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং বলছে, এই পৃথকীকরণের ফলে কর নির্ধারণকারী ও আদায়কারীরা আলাদা থাকবে। ফলে একচেটিয়া ক্ষমতা বা গোপন সমঝোতার সুযোগ থাকবে না।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ১৯৯৩ সালে এনবিআরের নীতি ও প্রশাসন দুটোকে আলাদা করার জন্য বলেছিল। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিশ্বব্যাংকও চাপ দিয়েছিল। কিন্তু তখন তা বেশি দূর এগোয়নি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যবসায়ী মহল, সামষ্টিক অর্থনীতির বিশ্লেষক ও বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীরা এনবিআরের বর্তমান মডেল থেকে সরে আসার তাগিদ দিয়ে আসছিলেন। এ ক্ষেত্রে মোটা দাগে তাদের পরামর্শ ছিল, রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনাকে আলাদা করা। এর মধ্যে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থা সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। এরই অংশ হিসেবে এনবিআর সংস্কারে গঠিত পাঁচ সদস্যের পরামর্শক কমিটি গত বছরের ডিসেম্বরে অর্থ উপদেষ্টার কাছে ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা’ নামে আলাদা বিভাগ করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে প্রতিবেদন জমা দেয়। তারই আলোকে গত সোমবার রাতে অধ্যাদেশ জারি করা হয়।
অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রশাসনিক পদগুলো প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের পাশাপাশি আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের রাখা হয়েছে। রাজস্ব নীতি বিভাগ কর আইন প্রয়োগ ও কর আদায় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে। রাজস্ব সংগ্রহের মূল কাজ করবে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ।
অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে তিন দিনের কলম বিরতি কর্মসূচি ঘোষণা করেছে এনবিআরের ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা। গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পূর্বঘোষিত অবস্থান কর্মসূচি থেকে এ ঘোষণা দেন শুল্ক ও আয়কর কর্মকর্তারা। তারা বলেন, দেশের সব কর অঞ্চল, ভ্যাট কমিশনারেট ও শুল্ক স্টেশনসহ এনবিআরের সব দপ্তরে এ কর্মসূচি পালন করা হবে।
কর্মকর্তাদের কর্মসূচির বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, এনবিআর বিলুপ্ত হয়ে দুটি বিভাগ গঠিত হলেও প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের দুশ্চিন্তার কারণ নেই। সব দেশেই এমন আলাদা বিভাগ থাকে। এনবিআরের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করেই এটা করা হয়েছে। রাজস্ব আদায়ে এর প্রভাব পড়বে না। তিনি আরও বলেন, বিশ্বের সব দেশেই রাজস্ব নীতি ও বাস্তবায়ন বিভাগ পৃথক। যাঁরা নীতি প্রণয়ন করবেন, তাঁদের পেশাদার হতে হবে; অর্থাৎ দেশের জিডিপি, অর্থনীতি, পরিসংখ্যান-এসব বিষয়ে ধারণা থাকতে হবে। যাঁরা নীতি প্রণয়ন করবেন, তাঁরা আবার রাজস্ব সংগ্রহও করবেন, তা হতে পারে না।
এনবিআর ভেঙে দুটি বিভাগ করার সিদ্ধান্তকে সাহসী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ বলেছেন, সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, এই সংস্কারের ফলে বাংলাদেশের কর প্রশাসনের আধুনিকীকরণ, রাজস্ব বৃদ্ধি ও ব্যবস্থাপনা আরও দক্ষ হবে এমন সম্ভাবনা আছে। নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়ন কার্যক্রম আলাদা করার সিদ্ধান্ত ভালো পদক্ষেপ। এটি আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত উত্তম রীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। একটি বিভাগ নীতি প্রণয়ন ও আইন তৈরির কাজে যুক্ত থাকবে। অন্যটি আদায় ও বাস্তবায়নের কাজ করবে। এভাবে দায়িত্ব বণ্টনের মাধ্যমে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও গতিশীলতা বাড়ানো সম্ভব। এই কাঠামো বাংলাদেশের রাজস্বব্যবস্থাকে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও ক্রমবর্ধমান রাজস্ব চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে সহায়ক হতে পারে।
এনবিআর সংস্কারের সম্ভাব্য সুফল সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দায়িত্ব বিভাজনের ফলে কর নির্ধারণকারী ও আদায়কারীরা আলাদা থাকবে। ফলে একচেটিয়া ক্ষমতা বা গোপন সমঝোতার সুযোগ থাকবে না। প্রতিটি বিভাগ তাদের নির্দিষ্ট কাজে মনোযোগ দিতে পারবে, এতে দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও পেশাগত মান বৃদ্ধি পাবে।