আমাদের তরুণরা অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। সারা বিশ্বের উদাহরণ এখন আমাদের তরুণ সমাজ। আমাদের তরুণ সমাজের ডিকশনারিতে ‘অসম্ভব’ বলে কিছু নেই। অসম্ভবকে জয় করার এক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তরুণ সমাজ আমাদের জাতির জন্য সত্যিকার অর্থে একটি অনুপ্রেরণার উৎস। তরুণরাই আমাদেরকে পথ দেখাচ্ছে। তরুণরাই নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে যোদ্ধা। তারাই বাংলাদেশকে নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছে, নিয়ে যাচ্ছে স্বপ্নের সোনালি বন্দরে। বাংলাদেশ নামের দেশটা তারুণ্যের সৃষ্টি। বাংলাদেশের যত অগ্রগতি, যত অর্জন সবকিছু তারুণ্যের হাতেই। তরুণরাই এ দেশকে জন্ম দিয়েছে, তরুণরাই এ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যে কোনো সংকটে, যে কোনো দুর্যোগে তরুণরাই যেন পথ দেখিয়েছে। তরুণরাই যেন জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। এটা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। পৃথিবীর আর কোনো দেশ নেই যেখানে তরুণরা একটা দেশ বিনির্মাণ করে, তরুণরা যে কোনো সংকটে সব সময় কান্ডারি হয়ে সামনে আসে। আমাদের তরুণরা যেমন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছিল, আমাদের তরুণরা যেমন আত্মত্যাগ করে রক্তের বিনিময়ে এদেশের স্বাধীনতা এনেছিল, ঠিক তেমনি আমাদের তরুণরা চব্বিশে অকুতোভয় চিত্তে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটিয়েছে। বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে বুলেটকে বরণ করে ফ্যাসিবাদকে বিদায় করেছে আমাদের তরুণ সমাজ।
এদেশে ১৫ বছর ধরে জগদ্দল পাথরের মতো একটি স্বৈরাচারী ব্যবস্থা কায়েম ছিল। মানুষের ভোটের অধিকার হয়েছিল ভূলুণ্ঠিত। অর্থনৈতিক লুটপাটের এক রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বদলে একটি লুটতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেরকমই একটি দুর্বিষহ এবং দমবন্ধ অবস্থায় যখন মানুষ আশা ছেড়ে দিয়েছিল, সব স্বপ্ন মানুষের বিলীন হয়েছিল, এদেশের মানুষ যখন কার্যত ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছিল ঠিক সেই সময় তরুণরা গর্জে উঠল। তারা দেখাল যে কীভাবে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে হয়, কীভাবে ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করতে হয়। জুলাই বিপ্লব যে সফল হবে, জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে যে একটি সর্বব্যাপী রাহুর গ্রাস থেকে বাংলাদেশ মুক্তি পাবে সেটা শুরুতে কজন ভেবেছিল? কিন্তু যা অসম্ভব সেটা সম্ভব করে আমাদের তরুণ সমাজ, আমাদের শিক্ষার্থীরা। আবু সাঈদ, মুগ্ধর রক্তের বিনিময়ে আমরা অর্জন করি নতুন স্বাধীনতা। নতুন স্বাধীনতা অর্জনের পর আমাদের তরুণ সমাজ পথভ্রষ্ট হয়নি। তারা হাল ছেড়ে দেয়নি। তারা নতুন বাংলাদেশকে বিনির্মাণ করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে নিরন্তর ভাবে। এমনটি নয় যে বিপ্লবোত্তর সময়ে তরুণরা সব দায়িত্ব শেষ করে চলে গেল। এখানেই বিশ্বের অন্যান্য দেশের গণজাগরণ এবং তারুণ্যের বিপ্লবের সঙ্গে বাংলাদেশের বিপ্লবের পার্থক্য। আমরা দেখেছি যে গাজার গণহত্যা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে তারুণ্যের দ্রোহ হয়েছিল। কিন্তু সেই তারুণ্যের দ্রোহ শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হতে পারেনি। আবার আমরা দেখি যে আরব বসন্তের সময় মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোতে তারুণ্যের যে ঐতিহাসিক জাগরণ, সেই জাগরণ তিউনিসিয়া কিংবা মিসরে পরিবর্তন আনতে পারেনি। বরং তারুণ্যের বিপ্লবের পর দেশ অন্য পথে চলে গেছে। প্রতিবিপ্লব বিপ্লবের অর্জনকে ধ্বংস করে দিয়েছে। বাংলাদেশে তেমনটি হয়নি। আমাদের তরুণ সমাজ যেন অতন্দ্র প্রহরীর মতো জেগে আছে সে পর্যন্ত যে পর্যন্ত জনগণের স্বপ্ন পূরণ না হবে। সে পর্যন্ত তারা ঘরে ফিরবে না- এমন একটি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনোবল আমাদের তরুণ সমাজের মধ্যে।
জুলাই বিপ্লবের পর এদেশে নানা রকম ষড়যন্ত্র হয়েছে। কারণ একটি ফ্যাসিস্ট সরকার যখন ১৫ বছর জগদ্দল পাথরের মতো ক্ষমতা আঁকড়ে থাকে, তখন সমস্ত সমাজের মধ্যে পচন ধরে, ঘুণ ধরে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি কাঠামোতে। আমাদের বিচার, আমাদের প্রশাসন, আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ রাষ্ট্রের সবকিছুই পদস্খলিত হয়েছিল। সেখান থেকে দেশকে একটা নতুন স্বপ্নের পথে নিয়ে যাওয়া অনেক কঠিন কাজ। এর মধ্যে নানা রকম প্রলোভন থাকে, থাকে পথভ্রষ্ট হওয়ার নানা রকম হাতছানি। কিন্তু এসব উপেক্ষা করে আমাদের তরুণরা যেন তাদের আস্থা এবং বিশ্বাসে অবিচল। আমাদের তরুণরা একটা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে। কেমন হবে সেই বাংলাদেশ? আমাদের তরুণদের স্বপ্নের বাংলাদেশ হলো বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিক সমান অধিকার পাবে। রাষ্ট্রের মধ্যে দুর্নীতি থাকবে না, অনিয়ম থাকবে না, রাজনীতি হবে স্বচ্ছ, জবাবদিহিতামূলক। ক্ষমতার ভারসাম্য থাকবে। মানুষ মানুষের ভেদাভেদ থাকবে না। যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পাবে। যোগ্যতা অনুযায়ী ব্যবসাবাণিজ্য নিশ্চিত হবে। কেউ পক্ষপাতিত্বের শিকার হবে না। অযথা কেউ হয়রানির শিকার হবে না। এমন একটি ঐক্যের বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে আমাদের তরুণ সমাজ। এমন স্বপ্ন দেখেছিল আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা ১৯৭১-এ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। স্বাধীন দেশে তরুণরা পথ দেখাতে পারেনি। তারা বিভ্রান্তির চোরাগলিতে আটকে পড়েছিল অথবা ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। কিন্তু এবারের জুলাই বিপ্লব বাংলাদেশের জন্য শুধু নয়, বিশ্বের জন্যই একটা অনুকরণীয় উদাহরণ। আমাদের তরুণ সমাজ বিপ্লবের পর রাষ্ট্রযন্ত্র জমে থাকা আবর্জনা পরিষ্কারের কাজ করে যাচ্ছে নিরলস ভাবে। এখনো তাদের আন্দোলন শেষ হয়নি। যতক্ষণ পর্যন্ত নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা চলতেই থাকবে। আমাদের তরুণরা জুলাই বিপ্লবের পর বিচার বিভাগের সংস্কার করেছে। ঘুণে ধরা প্রশাসন এবং ফ্যাসিবাদের তাঁবেদারদের চিহ্নিত করেছেন, অনেকে সরিয়েছে। বাকিদের সরানোর জন্য আমাদের তরুণরা কথা বলে যাচ্ছে নিরন্তর। জুলাই বিপ্লবের নায়করা সদা জাগ্রত।
সাম্প্রতিক সময়ে তরুণদের আরেকটি বিজয় বাঙালি জাতি প্রত্যক্ষ করল। আওয়ামী লীগের যারা বিভিন্ন গণহত্যার সঙ্গে জড়িত, যারা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে জনগণের ওপর স্টিমরোলার চালিয়েছিল, তাদের বাংলাদেশে রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই। এই কথাটি সকলেই বলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু তারপরও বিভিন্ন কারণে এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। তরুণরা অপেক্ষা করেছে, তারা দাবি জানিয়েছে, অনুরোধ করছে। কিন্তু কিছুতেই কোনো কাজ হয়নি। অবশেষে আমাদের তরুণ সমাজ আবার রাজপথে নেমে এলো। যারা তাদের বুকের ওপর গুলি চালিয়েছে, যারা তাদেরকে গুম করেছে তারা স্বাধীন দেশে রাজনীতি করে কীভাবে? এই কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নাৎসি রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এখন এই নাৎসিবাদ জার্মানিতে নিষিদ্ধ। ঠিক তেমনিভাবে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার জন্য তারা আবার জনগণকে ডাক দিল, সেই ডাকে সাড়া দিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনগণ রাজপথে নেমে এলো। কারণ আমাদের তরুণরা যে নির্মোহ, তারা যে নিজের স্বার্থের জন্য নয়, বরং সবার জন্য, সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য এরকম ডাক দিচ্ছে। এটা আমাদের জনগণ এখন বিশ্বাস করে এবং তরুণদের প্রতি আস্থাশীল। আর সেই জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে অন্তর্র্বর্তী সরকার সঠিক ভাবে দ্রুততার সঙ্গে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করল। এর মধ্য দিয়ে জুলাই বিপ্লবের সাফল্যে আরও একটি পালক যুক্ত হলো। এখন আমাদের তরুণ সমাজ বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য কাজ করছে।
আমাদের প্রায়ই শুনতে হতো আমাদের তরুণরা বিভ্রান্ত। তারা বিদেশে চলে যেতে চায়। তারা এ দেশ নিয়ে উদাসীন। বিশেষ করে তরুণ রাজনীতিমনস্ক নয়- এমন একটি কথা আমাদের সমাজে প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই অচলায়তন ভেঙে দিয়েছে আমাদের বিপ্লবীরা। এখন এদেশের মানুষ ঘরে ঘরে নীতিবান নির্ভীক এবং মেধাবী তরুণ চায় সবাই। আমাদের তরুণ সমাজ দেখেছে যে তারা প্রচলিত ঘুণে ধরা, নষ্টভ্রষ্ট রাজনীতির সমর্থন করে না। তারা সমর্থন করে নতুন রাজনীতি যে রাজনীতিতে সম্ভাবনার দুয়ার উন্মুক্ত হয়, যে রাজনীতিতে বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়ায়। যে রাজনীতির কারও তাঁবেদারি করতে শেখায় না, বরং স্বাধীন সার্বভৌম একটি বাংলাদেশ হিসেবে মনে আত্মপ্রকাশ করতে শেখায়। তরুণরা পরাভব মানে না। তারা পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে, ক্রীতদাসের বন্দি থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে চায়।
আমাদের দেশের মানুষ বহু বছর পরে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছে। তারা দেখতে পারছে যে, বাংলাদেশের নেতৃত্বের শূন্যতা নেই। বিশ্বব্যাপী যখন তরুণ সমাজ বিভ্রান্ত, রাজনীতিতে নতুন নেতৃত্বের শঙ্কা, পুরোনো বয়স্ক ব্যক্তিরা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছেন, তরুণরা রাজনীতিতে আগ্রহহীন, সেখানে আমাদের এক সম্ভাবনাময় তরুণ নেতৃত্ব বিকশিত হচ্ছে। আমাদের সামনে এবং জনগণের কাছে তারা ‘আইকন’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এই তরুণরা যে বাংলাদেশকে বদলে দিতে পারবে তা মানুষ সবাই বিশ্বাস করে। আমাদের তরুণরা এই ভূখণ্ডকে মানুষের জন্য বাসযোগ্য করতে যাচ্ছে। আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বাংলাদেশকে বিশ্বের মানচিত্রে দাঁড় করাতে চাইছে। এটি তরুণদের এক নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমের একটা বহিঃপ্রকাশ। সারা বিশ্বে এটি একটি অনন্য নজির।
আমরা জানি যে ২০০৪ সালে বিশ্বের সেরা দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের স্থান পেয়েছিল বিপ্লবের জন্য। একটা সময় বাংলাদেশকে নিয়ে বলা হতো এটা বন্যা, দুর্ভিক্ষ, দুর্বিপাকের দেশ। সেখান থেকে বাংলাদেশকে বলা হতো এদেশ হলো বিদেশিদের ঋণনির্ভর দেশ। তারপর এলো বাংলাদেশ সামরিক শাসনের দেশ। দেশ সম্ভাবনা বিহীন একটি দেশ। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক এবং ক্ষুদ্র ঋণ জাগরণের কারণে বাংলাদেশের পরিচয় বিশ্বে পাল্টে যায়। বাংলাদেশকে শান্তিতে জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস হিসেবে পরিচিতি পায়। কদিন আগেও বিদেশে গেলে বলত তুমি কি ড. ইউনূসের দেশের? এখন বাংলাদেশকে বিশ্ব চিনছে তারুণ্যের শক্তিতে ভরপুর একটি সম্ভাবনাময় হিসেবে। তারুণ্যের প্রাণশক্তিতে ভরপুর একটি দেশ, যে দেশের তরুণরা স্বপ্ন দেখায়, স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে এবং স্বপ্ন পূরণের জন্য আত্মত্যাগ করে। আগামীর ভবিষ্যতের জন্য তরুণরা বর্তমানকে বিসর্জন দেয়। এরকম তরুণ সমাজ বিশ্বে আর আছে কি? আর এজন্যই সারা বিশ্বে তারুণ্যের অহংকার জুলাই বিপ্লবের নায়করা। বিশ্বকে বদলে দেওয়ার পথ প্রদর্শক আমাদের তরুণ সমাজ।