২০১৮ সালের ঘটনা। নির্বাচনের বছর। পরিবার নিয়ে সুখেই কাটছিল শাকিলার (ছদ্মনাম) দিনগুলো। হঠাৎ যেন অন্ধকার নেমে তার জীবনে। সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ওই নারীকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় অজ্ঞাত স্থানে। দুই হাত দুই দিকে বেঁধে ঝোলানো হয়। খুলে নেওয়া হয় ওড়না। এরপর টানা ২৪ দিন আটকে রেখে চলে পাশবিক নির্যাতন। শাকিলা এখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন। সেই রোমহর্ষক স্মৃতি তাকে তাড়া করে ফেরে সবসময়। গুম কমিশনের কাছে ভয়াবহ দিনগুলোর কথা বর্ণনা করেছেন শাকিলা।
বিগত সরকারের শাসনামলে সারা দেশে গুমের শিকার হন অসংখ্য মানুষ। ভুক্তভোগীদের মধ্যে ছিলেন- মেধাবী শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী, সরকারি-বেসরকারি পেশাজীবী ও সাধারণ জনগণ। পুরুষদের পাশাপাশি গুম হন অনেক নারীও। মা-মেয়েকে একসঙ্গে অপহরণ করে মেয়ের সামনে মাকে নির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে। পরে মেয়েকে রাস্তায় ফেলে গেলেও ফিরে আসেননি মা। শাকিলা বেঁচে ফিরলেও গত ১৫ বছরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুম হওয়া অগণিত মানুষ আর ফিরে আসেননি। কমিশনের কাছে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৮৫০টি গুমের অভিযোগ এসেছে। ২৫৩ জন গুমের অকাট্য প্রমাণ পেয়েছে গুম সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারি। যারা বেঁচে ফিরেছেন তাদের মুখে উঠে এসেছে গুম ও নির্যাতনের ভয়াবহ বর্ণনা।
শাকিলা বলেন, ‘ওরা আমাদের ওড়না কেড়ে নিয়েছিল। আর যেহেতু জানালার দিকে মুখ করা ছিল, তাই আমাকে এভাবে দেখার জন্য পুরুষ মানুষ যে কতজন এসেছে তা ছিল বলার বাইরে। মানে তারা এভাবে একটা মজা পাচ্ছে। বলাবলি করতেছিল যে, এতদিন এমন পর্দাই করছ যে-এখন সব পর্দা ছুটে গেছে। আমার পিরিয়ড হওয়ার ডেট ছিল অনেক দেরিতে। কিন্তু আমার ওপর তারা এমনভাবে টর্চার করে যে, আমি অসুস্থ হয়ে যাই। সঙ্গে সঙ্গে আমার পিরিয়ড আরম্ভ হয়। আমি তাদেরকে প্যাডের কথা বললে তারা হাসাহাসি করত।’
৫৬ বছর বয়সি এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, নির্যাতনের একপর্যায়ে তার আঙুলের নখ উপড়ে ফেলা হয়। র্যাব-১০ কর্তৃক গুমের শিকার এক বক্তি জানান, গ্রিলের মধ্যে হ্যান্ডকাফ দিয়ে তাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো, যাতে বসতে না পারেন। একদিন একজন আঙুলে প্লাস দিয়ে ধরে, আরেকজন সুঁচ ঢুকিয়ে দেয়।
২০১৪ সালে র্যাবের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১২ কর্তৃক অপহৃত ৩০ বছর বয়সি এক যুবক জানান, তিনি ৩৯ দিন গুম ছিলেন। কথায় কথায় তাকে কিল থাপ্পড় মারত। প্যান্ট খুলে গোপনাঙ্গে ক্লিপ লাগিয়ে ইলেকট্রিক শক দিত। একবার চলন্ত গাড়িতে তুলে টানা প্রায় ১৫-২০ মিনিট ইলেকট্রিক শক দেয়। ব্যথায় ছটফট করতে গিয়ে দুই পায়ে প্রায় ১ ফুট করে ছিলে যায়। তিনি বলেন, ইলেকট্রিক শক এতটা ভয়াবহ যে, পায়ের ব্যথা টের পাচ্ছিলাম না। শক বন্ধ করার পর তিন মিনিট ধরে চেচাইছি। পরে ওরা মুখ চেপে ধরে।
গুম কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে নির্যাতনের জন্য র্যাবের টিএফআই সেলে ছিল এক ধরনের ঘূর্ণায়মান চেয়ার। সেখানে ভুক্তভোগীদের অত্যন্ত উচ্চগতিতে ঘোরানো হতো। এতে ভুক্তভোগীদের কেউ বমি, কেউ প্রস্রাব-পায়খানা করে ফেলতেন। কেউ অজ্ঞান হয়ে যেতেন। ২০১৭ সালে ডিজিএফআই ও র্যাব-২ কর্তৃক অপহৃত হয়ে ২০৮ দিন গুম ছিলেন ২৮ বছরের এক যুবক। তিনি তার দুঃসহ স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ... একটা মেশিনে উঠাইছিল। এরপর হাত, পা, মাথা বাঁধা হয়। মেশিনটা চালানোর পর মনে হচ্ছিল সব হাড় আলাদা হয়ে যাচ্ছে। আজব মেশিন। মেশিনটা ঘোরানো যায়। কখনো কখনো উল্টানো যায়। আবার ফ্লাট শোয়ানো যায়। এরপর ওইখানে থাকা অবস্থায় হাঁটুর ওপর বাড়ি দিয়ে জিজ্ঞাসা করেছে, ‘তুমি সরকারের বিরুদ্ধে কী কী ষড়যন্ত্র করেতেছ?’
২৭ বছর বয়সি এক যুবক র্যাব ১০ কর্তৃক অপহৃত হন ২০১৭ সালে। তিনি জানান, তাকে মুখ ওপর দিকে রেখে শুইয়ে মুখের ওপরে গামছা দিয়ে পানি ঢালত। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেত। তারপর গামছা সরিয়ে বলত, বল কী করছিস? তিনি জানতে চাইতেন তার অপরাধ কী? তারা উত্তর না দিয়ে আবার মুখে গামছা দিয়ে পানি ঢালত। অপরদিকে ৩৯১ দিন গুম থাকা ৪৬ বছর বয়সি এক ব্যক্তি কমিশনকে জানিয়েছেন, পুরুষ ভুক্তভোগীদের রাখার সেলগুলো ছিল ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ। সেলে টয়লেট ব্যবহারের জন্য নিচু বিল্ট-ইন প্যান বসানো ছিল। ভুক্তভোগীরা যখন শুয়ে থাকতেন, তখন তাদের শরীর প্রায়শই ওই প্যানের উপরেই পড়ে থাকত। যার ফলে তাদের ময়লা, প্রস্রাব ও মলের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে থাকতে হতো। এ ছাড়া এসব সেলে সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে প্রতিটি কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করা হতো। ফলে ভুক্তভোগীদের টয়লেট প্যান ব্যবহারের সময়ও চরম অপমান ও লজ্জার মধ্যে থাকতে হতো। ঠিকমতো ঘুমাতেও দিত না নিরাপত্তা প্রহরীরা।
২০২৩ সালে সিটিটিসি কর্তৃক ১৬ দিন গুম থাকা ৪৭ বছর বয়সি এক ব্যক্তি বলেছেন, তার চোখ কখনো গামছা দিয়ে, কখনো যমটুপি দিয়ে বাঁধা থাকত। হাত বাঁধা থাকত কখনো সামনে, কখনো পেছনে। কনুই ও দুই হাঁটুতে খুব জোরে জোরে মারত মোটা লাঠি দিয়ে। আমি মনে করতাম যে, আমার হাড়গুলো বুঝি ভেঙে যাবে। কিন্তু পরবর্তীতে দেখলাম যে ফুলে অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে, কিন্তু হাড় ভাঙছে এরকম বুঝিনি।
র্যাব-১১ কর্তৃক গুম হওয়া এক যুবক বলেন, আমার পা বেঁধে ওপর দিকে করে ঝুলিয়েছে। শরীরে কোনো পোশাক রাখেনি তখন। তারপরে এলোপাতাড়ি আমাকে দুজন একসঙ্গে পেটাতে থাকে। খুব সম্ভব বেতের লাঠি দিয়ে। পরে আমাকে অসংখ্যবার টর্চার করেছে এবং মারতে মারতে আমার এমন হয়েছে যে-চোখে বাঁধা কাপড় খুলে গেছে। নাকে-মুখে চড়, থাপ্পড় তো ছিলই। এ ছাড়া শুধু পেছনে মেরেছে। ওই সময়ে চামড়া ছিঁড়ে, মানে চামড়া ফেটে রক্ত ঝরেছে।
১৬ বছর বয়সি এক কিশোর র্যাব কর্তৃক অপহৃত হন ২০১৯ সালে। ২০ মাস ১৩ দিন তিনি গুম ছিলেন। জীবিত ফিরলেও এখন অনেকটা মানসিক ভারসাম্যহীন। ভুক্তভোগীর পিতা বলেন, ‘ছেলেটা এতিম, মায় মারা গেছে। লেখাপড়া করত। সব শেষ। ফেরার পরে (গুম থেকে) শুধু বসে থাকত। হঠাৎ রেগে যাইত। কেউ কিছু জিগাইলে থাপ্পড় দিত। এখন খালি একা একা হাসে, কিছু কাইলে ফেনায়, ঠিকমতো কথা কয় না। আগের মতো না। ডাক্তার দেখাইলাম, ওষুধ দেয়, খায় না। কয় শরীর কাঁপে, ঘুমে ধরে। ওষুধ ফালায় দেয়।’