ত্রাণ নিয়ে গাজা অভিমুখী গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা (জিএসএফ) নৌবহরের সবশেষ জাহাজটিও আটক করেছে ইসরায়েলি নৌবাহিনী। গতকাল সকালে গাজা উপকূলে ম্যারিনেট নামের জাহাজটির দখল নেয় তারা। ফলে নৌবহরে থাকা ৪৪টি জাহাজের ৪৬১ জন ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে আটক হন। আটক ফ্লোটিলা কর্মীর মধ্যে চারজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে এবং বাকিদের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন বলে জানিয়েছে ইসরায়েল।
তবে গাজায় ইসরায়েলি অবরোধ ভাঙতে নতুন করে গাজা অভিমুখে যাত্রা করেছে ১১টি জাহাজ। এসব জাহাজে প্রায় ১০০ অধিকারকর্মী আছেন। এদিকে বেপরোয়া ইসরায়েলের জলদস্যুতার প্রতিবাদে বিশ্বজুড়ে বিক্ষোভ করেছেন সাধারণ মানুষ ও মানবাধিকারকর্মীরা। তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জলদস্যুতার অভিযোগ তুলছেন।
জিএসএফের লাইভস্ট্রিম ভিডিওতে দেখা গেছে, গতকাল সকালে গাজা উপকূলে নৌবহরের সবশেষ জাহাজ ম্যারিনেটে জোর করে উঠে পড়ে ইসরায়েলি বাহিনীর সদস্যরা। পোল্যান্ডের পতাকাবাহী জাহাজটিতে ছয়জন ক্রু ছিলেন। এর আগে ম্যারিনেট বাদে নৌবহরের অন্য সব জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেয় ইসরায়েল। বুধবার রাতে গাজা থেকে ১২৯ কিলোমিটার দূরে ভূমধ্যসাগরে থাকা অবস্থায় ফ্লোটিলায় প্রথমবারের মতো সরাসরি বাধা দেয় ইসরায়েলি নৌবাহিনী। প্রথমে জাহাজে ধাক্কা দিয়ে ও জলকামান ব্যবহার করে হামলা করা হয়। ওই রাতেই ১৩টি জাহাজ আটক করে ইসরায়েলি সেনারা। এরপর বৃহস্পতিবার ম্যারিনেট বাদে বাকি সব জাহাজ আটক করে ইসরায়েলের আশদোদ বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। বহরে প্রায় ৪৪টি নৌযানে ৫০০ মানুষ ছিলেন। জিএসএফের ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, জাহাজগুলোয় থাকা ৪৬১ জন কর্মীকে আটক করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়ামের নাগরিকসহ ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচিত প্রতিনিধি, আইনজীবী, অধিকারকর্মী, চিকিৎসক ও সাংবাদিক রয়েছেন।
আটকদের মধ্যে চারজন ফ্লোটিলা কর্মীকে বহিষ্কার করেছে ইসরায়েল। বাকিদের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন বলে জানিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গতকাল সমাজমাধ্যম এক্সের পোস্টে দেশটি জানায়, গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলায় যোগদানকারী চারজন ইতালীয় নাগরিককে বহিষ্কার করা হয়েছে এবং বাকি কর্মীদের বহিষ্কারের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। ইসরায়েল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ প্রক্রিয়াটি শেষ করতে আগ্রহী। তারা দাবি করেছে, আটক ৪৬১ কর্মী নিরাপদ এবং সুস্থ আছেন।
এর আগে আটক সব কর্মীকে মুক্তি দিতে ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানায় গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা। তারা জানায়, আটকদের অনেকেই খোলা অনশন ধর্মঘট পালন করছেন। আটকের ঘটনা তাদের মিশনের সমাপ্তি চিহ্নিত করবে না। ইসরায়েলের নৃশংসতার মুখোমুখি হওয়ার এবং ফিলিস্তিন জনগণের পাশে দাঁড়ানোর আমাদের দৃঢ় সংকল্প অটল থাকবে বলে জানিয়েছে সংগঠনটি। এদিকে ইসরায়েলের অবরোধ ভাঙতে গাজা অভিমুখে নতুন করে যাত্রা করেছে আরও ১১টি জাহাজ। এসব নৌকায় প্রায় ১০০ জন অধিকারকর্মী আছেন। তবে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার ওয়েবসাইটে এ বহরের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। আন্তর্জাতিক সংস্থা ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন (এফএফসি) জানিয়েছে, ৩০ সেপ্টেম্বর কনসায়েন্স নামের জাহাজ আরও আটটি নৌকা নিয়ে যাত্রা করেছে। তাদের সঙ্গে ইতালি ও ফ্রান্সের পতাকাবাহী নৌবহর ‘থাউজ্যান্ড ম্যাডলিনস টু গাজা’ যোগ দিয়েছ। এ বহরে রয়েছে দুটি নৌকা। একসঙ্গে এ দুটি দল ১১ জাহাজের বহর নিয়ে গাজা অভিমুখে ছুটে চলেছে।
সংস্থাটি জানিয়েছে, তাদের ১৫ বছরের সমুদ্র অভিযানের অভিজ্ঞতা আছে। এর আগে তারা এফএফসি মাদলিন ও হান্দালা ফ্লোটিলায় অংশ নিয়েছিল। এবার অবরোধ ভাঙতে এফএফসি ব্যবহারিক পরামর্শ, দিকনির্দেশনা ও প্রক্রিয়াগত সহায়তা দিচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে বিক্ষোভ : গাজা অভিমুখী ত্রাণবাহী বহরের সবকটি নৌযান আটকের ঘটনায় বিক্ষোভে উত্তাল সারা বিশ্ব। ইউরোপ থেকে অস্ট্রেলিয়া, এশিয়া থেকে দক্ষিণ আমেরিকা পর্যন্ত দেশে দেশে বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নেমে ইসরায়েলের পদক্ষেপের তীব্র প্রতিবাদ জানায়। পাশাপাশি দেশটির বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞার দাবি তোলে। এ ঘটনায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জলদস্যুতার অভিযোগও তুলেছে অনেকে। স্পেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বার্সেলোনায় প্রায় ১৫ হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে ইসরায়েলের এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে। তারা ‘গাজা তুমি একা নও’ ‘ইসরায়েলকে বর্জন করো’ এবং ‘ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা চাই’ স্লোগান দেয়। আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন শহরে আইরিশ পার্লামেন্টের বাইরে মিছিল করে কয়েক শ মানুষ। সেখানে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থনকে প্রায়ই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আয়ারল্যান্ডের দীর্ঘ সংগ্রামের সঙ্গে তুলনা করা হয়।
এদিকে নৌবহরের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে গতকাল সাধারণ ধর্মঘট পালন করে ইতালির প্রধান শ্রমিক ইউনিয়নগুলো। রাজধানী রোমে বিক্ষোভে অংশ নেয় প্রায় ১০ হাজার মানুষ। তারা প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনিকে কর্মীদের পক্ষে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে। এ ছাড়া মিলান, তুরিন, ফ্লোরেন্স ও বোলোনিয়াতেও বিক্ষোভ হয়েছে। বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ভবনের সামনে বিক্ষোভ করে প্রায় ৩ হাজার মানুষ। তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের আহ্বান জানায়। এই সঙ্গে ফ্রান্সের প্যারিস, তুরস্কের ইস্তাম্বুল, সুইজারল্যান্ডের জেনেভা, কলম্বিয়ার বেগোতা, লিবিয়ার ত্রিপোলি, ব্রাজিলের ব্রাসিলিয়া, গ্রিসের এথেন্স, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর, তিউনিসিয়ার তিউনিসসহ বিশ্বের বিভিন্ন শহরে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে মানুষ।