ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সব অপকর্মের নির্দেশদাতা ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হয়ে উঠে ছিলেন দানবীয় শক্তির প্রধান।
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রসিকিউশন পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় এসব কথা বলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, বিরোধী মত দমনে গুম-খুনের রাজনীতির প্রবল করা হয়েছিল হাসিনা সরকারের আমলে। গুমের অভিযোগ নিয়ে থানায় গেলেও মামলা নিত না। গুম করে রেখে এতটাই নির্মম নির্যাতন করা হতো, এখনো সেসব পরিবারের সদস্যরা মুখ খুলতে সাহস পান না, পরে সমস্যা হতে পারে এ কথা চিন্তা করে। ফ্যাসিবাদ তৈরির হাতিয়ার হিসেবে বিচারাঙ্গনকেও ব্যবহার করা হয়েছে বলে যুক্তিতর্কে উল্লেখ করেন চিফ প্রসিকিউটর। গতকাল বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ প্রথম দিনের মতো যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর। এদিন জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট বর্ণনা দেন তিনি। এদিন তার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ না হওয়ায় আজ আবারও দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল। এদিন যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের একপর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বলেন, বিচারকরা যা কিছু করবেন, এর একটা নিয়ন্ত্রণ বা জবাবদিহি থাকা দরকার। প্রসিকিউশনের এ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন বিটিভি ও চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
অন্যদিকে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের বিরতিতে ব্রিফিংয়ে এসে সরাসরি সম্প্রচার চলাকালে সাইবার হামলা হয়েছে জানিয়ে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জানান, প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্ক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছিল। ঠিক ওই সময় আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ের ফেসবুক পেজের ওপর সাইবার অ্যাটাক করা হয়েছে। এর মাধ্যমে পেজটাকে সাময়িকভাবে ডিসেবল করে দিয়েছিল তারা। যদিও তাৎক্ষণিক উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, যুক্তিতর্কে বহু তথ্যপ্রমাণসহ তাদের নিষ্ঠুরতার বর্ণনা যেন দুনিয়াবাসী জানতে না পারে, এই অপরাধীরা তা চায় না। তাদের সহযোগীরাও এটা চায় না। সেজন্যই আমাদের এই ফেসবুক পেজের ওপর সাইবার হামলা চালিয়েছে তারা। তারা দুনিয়াকে এটা জানতে দিতে চায় না যে বিচারটা কতটা ট্রান্সপারেন্ট বা স্বচ্ছ হচ্ছে। তথ্যপ্রমাণগুলো কতটা অকাট্য সেটা তারা বুঝতে দিতে চায় না।
এ মামলায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি এই মামলার বাকি দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এর মধ্যে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন দোষ স্বীকার করে এ মামলায় রাজসাক্ষী হয়ে জবানবন্দি দিয়েছেন। গতকালও তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় চিফ প্রসিকিউটরকে সহযোগিতা করেন প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামীম। এ সময় প্রসিকিউশনের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন মো. মিজানুল ইসলাম, আবদুস সোবহান তরফদার, বি এম সুলতান মাহমুদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ান প্রমুখ। অন্যদিকে আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন উপস্থিত ছিলেন। যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের শুরুতে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল আইনের অধীনে মানবতাবিরোধী অপরাধের এই বিচার হচ্ছে। এ আইনটি সংবিধান কর্তৃক সুরক্ষিত, আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। এ আইনের অধীনে এর আগে দুই ট্রাইব্যুনালে ৫৬টি রায় হয়েছে। যুক্তিতর্কে শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার সরকারের শাসনের ফিরিস্তি তুলে ধরেন তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে, এর বিচার করার ক্ষমতা এই ট্রাইব্যুনালের রয়েছে। ওই সময় দেশে হাসিনার রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় ছিল। আওয়ামী লীগের কর্মপদ্ধতি ও মাইন্ডসেট এই ট্রাইব্যুনালের সামনে আমরা এনেছি।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, শেখ মুজিবের আমলে রক্ষী বাহিনী দিয়ে নাগরিকদের রাতে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হতো। এ কাজটি হাসিনার আমলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী করেছে গত ১৫ বছরে আয়নাঘর বানিয়ে। এ সংক্রান্ত ডকুমেন্টারি আমরা ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেছি। ১/১১ এর সেনা শাসনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, দাবি আদায়ের নামে আওয়ামী লীগ লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সেনাসমর্থিত শাসন এনেছে।
এরই ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসেন।
বিডিআর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, বিদেশি রাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তারের জন্য বাধা ছিল দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী। তাই পিলখানা হত্যার মাধ্যমে সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়। এটা ছিল শেখ হাসিনার ফ্যাসিজম কায়েমের প্রথম পদক্ষেপ। পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেন বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, যাতে ইচ্ছামতো নির্বাচন করা যায়। দ্বিতীয় ধাপে শুরু হয় জুডিশিয়াল কিলিং, এর মাধ্যমে আইন পরিবর্তন করে ফাঁসি দেওয়া হয়। হাসিনাকে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন, ‘আপনি (একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের) বিচার করেন। হাসিনা জবাব দেন, বিচার করার জন্য প্রমাণ কোথায় খুঁজে পাব। প্রধান বিচারপতি তখন বলেন, প্রমাণের ব্যবস্থা আমি করব।’
এ সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বলেন, বিচারকরা যা কিছু করবেন, এর একটা নিয়ন্ত্রণ বা জবাবদিহি থাকা দরকার। জবাবে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, এ ধরনের একটা কাউন্সিল আছে, যেটা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। এ সময় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের একজন সদস্যও যদি আইন ভঙ্গ করেন, তবে তখন কী হবে।
ক্রসফায়ারের নির্মমতা বর্ণনা করতে গিয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, মিরপুরে একজনকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করা হয়, তার মাথায় ঝাঁকড়া চুল ছিল। চুলে আগুন লেগে যায়। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হু-হু করে হাসছিল। আমরা তদন্তের সময় এ বিষয়ে একজনকে প্রশ্ন করেছিলাম, মাথায় কেন গুলি করা হয়? তারা উত্তর দেয়, ‘মাথায় গুলি না করলে মরতে দেরি হয়।’ এখান থেকেই ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের সময় ছাত্রদের পাখির মতো গুলি করার কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, আমরা বোঝাতে চাই যে, এ ঘটনা হঠাৎ করে হয়নি, এটি দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও প্র্যাকটিস।
যুক্তিতর্কে গুমের বিষয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, তখন পুলিশ গুমের মামলা নিতে চাইত না। হাই কোর্ট বলতেন, গুমের অভিযোগ পুলিশ তো স্বীকার করছে না। শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ড ছিল বিরোধীদের রাজনৈতিক আওয়াজ বন্ধ করে দেওয়ার প্রক্রিয়া। শাহবাগ ছিল সরকারের তৈরি করা মব। এ বিষয়ে হাসিনা সংসদে বলেছিলেন, ‘আমার মনটা শাহবাগে পড়ে থাকে’।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, অনেক ভিকটিম পরিবার মনে করে, গুমের অভিযোগ করলে, পরবর্তীতে তাদের সমস্যা হবে। নিপীড়নের খড়গ নেমে আসবে, পরিবারের অন্য সদস্যরাও নির্যাতনের শিকার হবেন। পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে গুমের ঘটনায় এ কারণে এখনো অনেক অভিযোগ আসেনি। তিনি বলেন, গুমে অভিযুক্তরা এখনো চাকরিতে বহাল আছে। ফলে ভিকটিমরা আস্থা পাচ্ছেন না। তারা মামলা করতে সাহস পাচ্ছেন না। প্রকৃত গুমের সংখ্যা ৬ হাজারেরও বেশি। ফেরত না আসার সংখ্যা ১ হাজারেরও বেশি। গুমের ঘটনায় গুম কমিশনে ১৮০০ অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযোগ জমা না পড়ার সংখ্যা আরও তিন গুণ বলে গুম কমিশন জানিয়েছে।
বিচার বিভাগের বিষয়ে যুক্তিতর্কে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, বিচারক নিয়োগে মেধা ও যোগ্যতা বিবেচনা না করে, দলীয় বিবেচনায় বিচারক নিয়োগ করা হয়েছে। খুনের মামলার আসামি, সুপ্রিম কোর্টে হামলায় জড়িত ব্যক্তিকে বিচারক নিয়োগ করা হয়েছে। এ বিচারকরা সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী যখন যে রকম রায় দেওয়ার দরকার, সে রকম রায় দিয়ে ১৫ বছর ধরে স্বৈরশাসন টিকিয়ে রেখেছেন। তিনি বলেন, আদালতকে ব্যবহার করে বিরোধী দল, মত দমন ও ফ্যাসিবাদ কায়েম করা হয়েছে। এই ট্রাইব্যুনালকে ব্যবহার করে এর আগে একসময় অতিবৃদ্ধ লোককেও আসামি করে আনা হতো, জামিন দেওয়া হতো না। আদালতের নিজস্ব কোনো স্বাধীনতা ছিল না।
তাজুল ইসলাম বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় মিটিং হতো, সেই মিটিংয়ে ডিসিশন হতো, জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানে কোথায় কোথায় মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হবে। সেখানে প্রটোকলের বাইরেও অনেকে থাকত। সেখানে হেলিকপ্টার ব্যবহার করার আলোচনা হয়। ওবায়দুল কাদের, আনিসুল হক, আসাদুজ্জামান খান ও সালমান এফ রহমানের সমন্বয়ে গ্যাং অব ফোর এ সিদ্ধান্ত নেয়।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, সালমান এফ রহমান প্রতিমন্ত্রী পলককে বলেছেন, ‘ইন্টারনেট তো বন্ধ করেছোই, টিভির সম্প্রচারও বন্ধ করে দাও, আমরা ক্র্যাকডাউনে যাব।’ ৫ আগস্ট যদি হাসিনার সরকার পতন না হতো, ৬ আগস্ট বাংলাদেশে আমরা যে কত মানুষের লাশ দেখতাম, তা কল্পনাও করা করতে পারি না। কারণ সালমান এফ রহমান উসকানি দিচ্ছিলেন বারবার। হাসিনা ও শেখ তাপসের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে আমরা লেথাল উইপন ব্যবহারের বিষয়টি ট্রাইব্যুনালে শুনিয়েছি। হাসিনা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেছিল সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে।
গত ৮ অক্টোবর প্রসিকিউশনের পক্ষে সর্বশেষ ও ৫৪তম সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীরকে আসামিপক্ষের জেরা শেষ হয়। আসামিরা পলাতক থাকায় আইন অনুযায়ী তাদের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য গ্রহণের সুযোগ নেই। ফলে তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়েই এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়। এর পরের ধাপই যুক্তিতর্ক উপস্থাপন। উভয় পক্ষের যুক্তিতর্কের পরই মামলাটি রায়ের দিকে এগিয়ে যাবে।
এর আগে গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এ মামলায় তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ মোট ৮ হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে তথ্যসূত্র ২ হাজার ১৮ পৃষ্ঠার, জব্দ তালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি ৪ হাজার পাঁচ পৃষ্ঠার ও শহীদদের তালিকার বিবরণ ২ হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার। সাক্ষী করা হয়েছে ৮১ জনকে। পরে সম্পূরক আনুষ্ঠানিক অভিযোগে আরও তিনজনকে সাক্ষী করা হয়েছে।