শুক্রবার, ১০ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস-২০২৩

জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস-২০২৩

আজ পালিত হচ্ছে জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য ‘স্মার্ট বাংলাদেশের প্রত্যয়, দুর্যোগ প্রস্তুতি সব সময়’। প্রতি বছরই ঝড়, বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন দুর্যোগের চোখ রাঙানি থাকে বাংলাদেশের ওপর। তবে পূর্বাভাস ও পূর্বপ্রস্তুতির কারণে দুর্যোগের ক্ষতি কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। দুর্যোগে নতুন আতঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছে ভূমিকম্প। এ দুর্যোগ ঠেকাতে সঠিক নিয়ম মেনে ভবন নির্মাণ এবং স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহারে জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এসব নিয়ে সম্প্রতি ইডব্লিউএমজিএল কনফারেন্স কক্ষে এক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। বৈঠকের চুম্বকাংশ তুলে ধরেছেন জয়শ্রী ভাদুড়ী, হাসান ইমন, রাশেদ শাহেদ আবদুল কাদের। ছবি তুলেছেন রোহেত রাজীব

 

যে কোনো দুর্যোগে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে

ক্যাপ্টেন (অব.) বি তাজুল ইসলাম

সভাপতি, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়

মানব সভ্যতা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে যতই শক্তিশালী হোক না কেন, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করার শক্তি আমাদের নেই। কিন্তু সে জন্য আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারব না। এগুলো নিয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে। কীভাবে রক্ষা পাওয়া যায়। এ জন্য প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন। সে কারণেই দুর্যোগ পূর্বপ্রস্তুতি। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ১০ লাখ মানুষ মারা গেছে। কিন্তু এখন আর সে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হবে না। কারণ আমাদের রয়েছে সব ধরনের পূর্বপ্রস্তুতি। যা করছি সব জনগণের জানমাল রক্ষা করার জন্য। এখন সেটাই মুখ্য বিষয়। আমরা জানি না, কখন কোন দুর্যোগ হানা দেবে। প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা অনেক তথ্য আগাম পাচ্ছি। এসব দুর্যোগ নিয়ে কীভাবে বসবাস করব তা শিখছি। বিদ্যা-বুদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষেরও পরিবর্তন এসেছে। সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষ শুনে এসেছে- এই পৃথিবী একদিন ধ্বংস হবে। তারপর এক দিন শুনেছে- সৃষ্টিকর্তা এক দিন পৃথিবী ধ্বংস করবেন। এখন মানুষ শুনছে, মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলে পৃথিবী ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। এখনই যদি ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়, তাহলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। আসলে তুরস্ক-সিরিয়ার মতো কিছু ঘটলে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। রানা প্লাজা ধসে আমাদের অনেক হিমশিম খেতে হয়েছে। এই মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আমাদের চেষ্টা থাকবে মানুষকে দুর্যোগ ও বিপর্যয় থেকে সুরক্ষিত রাখার। এ ক্ষেত্রে মানুষকে বিবেক দিয়ে চিন্তা করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্ত এবং রাজউকের বিল্ডিং কোড মেনে বাড়ি নির্মাণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন নজরদারি। দরকার সঠিক জনবল। বাংলাদেশে এখনো অনেক বেকার রয়েছে। তাদের চাকরি দিন। বিল্ডিং কোড মেনে বাড়ি নির্মাণ হচ্ছে কি না তদারকি করান। পাশাপাশি বাড়িওয়ালাকে সজাগ থাকতে হবে। মূলকথা দুর্যোগ নিয়ে আমাদের বসবাস করতে হবে। বৃদ্ধি করতে হবে সচেতনতা। সাধারণ জনগোষ্ঠীর মাঝে ভূমিকম্প সম্পর্কে তুলে ধরা উচিত। গণমাধ্যমের মাধ্যমে সেসব মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। তবে মানুষ দুর্যোগের পূর্ব ও পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে জানতে পারবে। সবাই যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকি, তাহলে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব।

 

দুর্যোগ পূর্বাভাসকে স্মার্টকরণের আওতায় নিয়ে আসতে হবে

মো. কামরুল হাসান এনডিসি

সচিব, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়

এ বছরের দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়- স্মার্ট বাংলাদেশের প্রত্যয়, দুর্যোগ প্রস্তুতি সব সময়। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়াই আমাদের লক্ষ্য। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে। দুর্যোগ প্রতিরোধে সব ধরনের পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এতে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি প্রশংসনীয়ভাবে কমিয়ে আনা হচ্ছে। অতীতে বাংলাদেশ ছিল রি-অ্যাক্টিভ, এখন প্রো-অ্যাক্টিভ। রি-অ্যাক্টিভ হলো ঘটনা ঘটার পর ব্যবস্থা গ্রহণ। যেমন- উদ্ধার তৎপরতা, সেবা ও ত্রাণ সরবরাহ ইত্যাদি। আর প্রো-অ্যাক্টিভ হলো ঘটনা ঘটার আগেই প্রস্তুতি নেওয়া। অর্থাৎ কী করব, কীভাবে প্রতিহত করব, কী করলে প্রতিরোধ করা সম্ভব। সেই প্রতিহতের বিষয়টি হচ্ছে আগাম প্রস্তুতি। আমি যেটা মনে করি, আমাদের পূর্বাভাসটাকে স্মার্টকরণের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। আমরা যদি পূর্বাভাসটা ঠিকমতো না দিতে পারি, সে ক্ষেত্রে আমরা বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি প্রতিরোধ করতে পারব না। জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। ধন-সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। যে পূর্ব-প্রস্তুতির কথা বলা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে একটি কথা না বললেই নয়। সেটি হলো- ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে এমন কোনো আধুনিক প্রযুক্তি হয়নি যে, আমরা আগে কোনো পূর্বাভাস পাব। বন্যার ক্ষেত্রে তিন দিন আগে আমরা পূর্বাভাস দিতে পারি। ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে সাত দিন কিংবা ১০-১৫ দিন আগে থেকে আমরা পূর্বাভাস দিতে পারি। এমনকি বজ্রপাতের ৪০ মিনিট আগে থেকে আমরা পূর্বাভাস দিতে পারি। কিন্তু ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে আমরা তেমন কোনো পূর্বাভাস দিতে পারি না। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো- সচেতনতা। আতঙ্কিত না হওয়া, বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করা। অধ্যাপক মহোদয় ভূমিকম্পের অতীত ইতিহাস থেকে সার্বিক বিষয় সব কিছু আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। আমি বলতে চাই- আতঙ্কিত হবেন না এবং সরকার বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) প্রণয়ন করেছে। সেটি মেনে চলবেন। বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করুন। ভবন নির্মাণের সময় যেসব বিষয় দেখা উচিত অর্থাৎ ভবনের স্ট্রাকচারাল বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করে তবেই ভবন নির্মাণ করুন।

 

সক্ষমতা আছে, দরকার সচেতনতা

মো. মিজানুর রহমান

মহাপরিচালক, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর

১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা রোধে সিপিপি তৈরি করেছেন। বিভিন্ন স্থানে মুজিবকিল্লা নির্মাণ করেছেন। এখন তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়ন করছেন। দুর্যোগ রোধে সব ধরনের কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন। আমাদের সক্ষমতা বেড়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে। একই সঙ্গে শিক্ষার মান বেড়েছে। মানুষও সচেতন হয়েছে। যে কোনো দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা এখন অনেকটাই সম্ভব। তিনি বলেন, আগে ঘূর্ণিঝড়সহ বড় দুর্যোগ হলে মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে আসত না। কারণ হিসেবে জানা যায়, তাদের গৃহপালিত পশুসহ গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র রেখে আসত না। যদি কেউ এগুলো নিয়ে যায় বা চুরি হয়ে যায়। এ জন্য দুর্যোগে অনেক প্রাণহানি হতো। এখন আমরা পশুদের জন্যও আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করেছি। যেন মানুষ কোনো সংকোচ ছাড়াই আশ্রয় কেন্দ্রে আসতে পারে। এ ছাড়াও দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়াতে নানান কার্যক্রম চলমান। মহাপরিচালক বলেন, ১৮৯৭ সালে এই দেশে বড় ভূমিকম্প হয়। সে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৮.২। ওই ভূমিকম্পে মৃত্যুর হার ছিল ১৫ শতাংশ। ঠিক ১২৫ বছর পর এখন যদি এই মাত্রার ভূমিকম্প হয় তাহলে আমাদের কী অবস্থা হবে? সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবে পুরান ঢাকা। পুরান ঢাকার রাস্তা নেই, ভবন ধসে পড়লে যত আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকুক না কেন? ওই এলাকায় প্রবেশের জায়গা তো নেই। এখন আগের তুলনায় রড ও সিমেন্টের মান অনেক ভালো। সবাই যেনতেনভাবে ভবন না করি। বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) মেনে ভবন তৈরি করি। তাহলে ভূমিকম্পসহ সব ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ রোধে অনেকটা সহায়ক হবে। আমাদের লক্ষ্য ছিল, ৫৫-৬০ হাজার স্বেচ্ছাসেবীকে প্রশিক্ষণ দেব। ইতোমধ্যে ৪০ হাজার লোককে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। তবে আমাদের উদ্যোগ নেওয়া উচিত, ঢাকার আশপাশের উপশহর বা জেলাগুলোতে স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা বাড়িয়ে প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। কারণ ঢাকা শহর ক্ষতির সম্মুখীন হলে আশপাশের জেলাগুলোর স্বেচ্ছাসেবীরা এসে যেন উদ্ধার কাজ করতে পারেন। এই কর্মকর্তা বলেন, শিশুরা মোবাইল ফোনে প্রচুর গেম খেলে। এই শিশুদের গেমের মাধ্যমে ভূমিকম্পসহ দুর্যোগের প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। এই গেমে ভূমিকম্পসহ দুর্যোগ হলে করণীয় কী এবং কীভাবে নিজেকে রক্ষা করতে হবে এ রকম উপকরণ দেওয়া যায়। তাহলে শিশুরাও সচেতন হবে। পাশাপাশি অগ্নিকাণ্ডের সময় ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয় ইন্টেরিয়রের ফলস সিলিংয়ের জন্য। তাই ভবনের ফলস সিলিং বন্ধ করার জন্য সরকারকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ঘোষণা দেওয়ার পরামর্শ দেন।

 

ঝটিকা বন্যা বা (ফ্লাস ফ্লাড) নিয়ে কাজ করতে হবে

প্রফেসর মাহবুবা নাসরিন

উপ-উপাচার্য (শিক্ষা), বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

বঙ্গবন্ধুর সময় থেকে মূলত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শুরু হয়। এরপর থেকে বাংলাদেশের মানুষ দুর্যোগ নিয়ে ভাবতে শুরু করে। গত বছরও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনুষ্ঠানে আমার থাকার সুযোগ হয়েছে। আমি ১৯৯১ সাল থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করছি। আমরা যদি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে চাই তাহলে দুর্যোগের পূর্ববর্তী সতর্কবার্তার ক্ষেত্রে আমাদের উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে অনেক কাজ করতে হবে। এ সময়কার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে উন্নয়ন এখন চোখে দৃশ্যমান। গত বছর থেকেও এ বছর আমরা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক এগিয়েছি। সতর্কবার্তায় আমাদের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এখন ঝটিকা বন্যা বা ফ্লাস ফ্লাড নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। সে বিষয়ে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। অনলাইন অপারেশনাল ড্যাশবোর্ডের মাধ্যমে দুর্যোগের সব তথ্য সবার কাছে পৌঁছাতে হবে। বজ্রপাত থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষায় বজ্রপাত ডিটেক্ট দেশের আরও অনেক জায়গায় স্থাপন করতে হবে। কমিউনিটি রেডিওর ব্যাপক ব্যবহার করতে হবে। এমনকি অনলাইনের মাধ্যমে দুর্যোগের তথ্য সবার কাছে পৌঁছাতে হবে। নারী ও শিশুবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে। সবার কাছে তথ্য পৌঁছে দিতে হবে- সে ধরনের প্রযুক্তি আমাদের ব্যবহার করতে হবে।

 

দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি নিতে হবে

অধ্যাপক . মো. জিল্লুর রহমান

চেয়ারম্যান, ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

দুর্যোগ প্রস্তুতি চলমান প্রক্রিয়া। উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতিরোধে জোর দিয়ে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। দুর্যোগ প্রস্তুতি ও উদ্ধার তৎপরতায় বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল। সম্প্রতি ভূমিকম্প নিয়ে আলোচনা বেড়েছে। তাই ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড মানতে হবে, ভবন শক্তিশালী করতে হবে। দুর্যোগ প্রতিরোধে দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তুতি নিতে হবে। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে দেশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। সে পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে এখন ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি এক ডিজিটে কমিয়ে আনা হয়েছে। এটা হয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতির কারণে। ঘূর্ণিঝড়ের আগে সাইক্লোন শেল্টার, মুজিব কেল্লা নির্মাণ করায় জানমালের ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে বন্যাপ্রবণ অঞ্চল। প্রচুর পানি ছোট এলাকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতে গিয়ে প্লাবিত করে। এটা প্রাকৃতিক ও নিত্যদিনের সঙ্গী। আগে বন্যার পানি দ্রুত নেমে যেত। কিন্তু এখন দেরি হচ্ছে। বন্যা দীর্ঘায়িত হওয়ায় ক্ষতি বেশি হচ্ছে। সম্প্রতি সিলেটের বন্যায় এ চিত্র দেখা গেছে। যেখানে ব্রিজ দরকার ছিল, সেখানে কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে পানি নামতে সময় লাগছে। সিলেটে শতবর্ষের মধ্যে ভয়াবহ বন্যা গত বছর হয়েছে। রাস্তা, কালভার্ট উঁচু হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো এটা নিয়ে গবেষণা করতে হবে। এখন ভূমিধস আতঙ্কও অনেক। বিশেষত পাহাড়ি অঞ্চলে। এসব অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র মানুষের বাস। ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় বসবাস করায় ভূমিধস হলে ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে। ভূমিকম্প নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৮৮৫ সালে মানিকগঞ্জে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল। ৭ মাত্রার এ ভূমিকম্পে মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ১৮১৯ সালে শ্রীমঙ্গলে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। ২৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিল। এটাকে গ্রেট আসাম ভূমিকম্প বলা হয়। এই ভূমিকম্প ৮ দশমিক ১ মাত্রায় অনুভূত হয়েছিল। ভূমিকম্পের উৎস সম্পর্কে ধারণা করতে পারলে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কমানো যেত। তাই ভূমিকম্পের ঝুঁকি ঠেকাতে বিল্ডিং কোড মানতে হবে। মনে রাখবেন, ভবন শক্তিশালী হলে ক্ষয়ক্ষতি কম হবে।

 

আবহাওয়ার বার্তা ঠিকভাবে পৌঁছানো গেলে প্রাণহানি কমে আসবে

মুহাম্মদ মবিনুর রহমান

সহকারী প্রকৌশলী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মুজিবকিল্লা নির্মাণ, সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্প

দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। প্রতিবছর বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ এখানে হয়ে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। ১৯৭০ সালের পর এ দেশে কয়েকটি বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। সর্বশেষ তিনটি ঘূর্ণিঝড় বেশ ভয়ংকর ছিল। এসবে ব্যাপক ঘরবাড়ির ক্ষয়ক্ষতি ও মানুষের জীবনহানির ঘটনা ঘটেছে। অবস্থানগত কারণে সাইক্লোনে ঝুঁকিও রয়েছে। দক্ষিণা সাইক্লোন সৃষ্টির জন্য সাধারণত ২৭ ডিগ্রি তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়, তা বঙ্গোপসাগরে বিরাজ করে। ওয়েদার আন্ডার গ্রাউন্ড নামে একটি ওয়েবসাইটে জানানো হয়, বিশ্বের ভয়ংকর ৩৫টি মৌসুমি ঘূর্ণিঝড়ের তালিকায় ২৬টি বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরে হয়েছে। বিশ্বব্যাংক ২০০৯ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানায়, উষ্ণায়নে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অন্যতম। প্রাকৃতিক ঝড়ের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে আমরা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি ও কৃষি ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তার ঝুঁকিতে বাংলাদেশ রয়েছে। আমাদের সতর্কবার্তায় স্মার্টনেস আনতে হবে। সাধারণত আমাদের আবহাওয়া বার্তা ১০৯০ তে প্রচার করা হয়। আবহাওয়ার বার্তা সঠিকভাবে পৌঁছানো গেলে প্রাণহানি কমে আসবে।

 

সারা বছর চলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিরোধ কার্যক্রম

এম আবেদ আলী

কুমিল্লা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা

কুমিল্লা জেলা কার্যালয় বছরে দুটি দিবস পালন করে। এ ছাড়া বছরব্যাপী বিভিন্ন কার্যক্রম করে থাকে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার আয়োজনে দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস ও আন্তর্জাতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দিবস পালিত হয়ে আসছে। এ দিবস ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ কার্যক্রম করে থাকে। মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্স, স্কাউট, রেড ক্রিসেন্ট মিলে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মহড়া কার্যক্রম হয়ে থাকে। সারা বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমাদের মহড়া কার্যক্রম চলমান থাকে। এসব ব্যবস্থাপনার কারণে সারা বিশ্বে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে।

 

প্রাণহানি কমাতে দেশজুড়ে বজ্রপাত চিহ্নিতকরণ বসানো হয়েছে

মো. ইসমাইল হোসেন

উপ-প্রকল্প পরিচালক, ১৫ মিটার দৈর্ঘ্য পর্যন্ত সেতু কালভার্ট নির্মাণ প্রকল্প

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিকল্পনায় ১৯৭২ সালে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র চালু করা হয়। এর অধীনে দেশে বর্তমানে ৩৫০টি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র সচল রয়েছে। ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সাহায্যে ৭-১০ দিন পূর্বাভাস নির্ভুলভাবে পাওয়া যায়। বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে দেশের আটটি জায়গায় বজ্রপাত চিহ্নিতকরণ যন্ত্র বসানো হয়েছে। দুর্যোগ সহনীয় বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৩১২টি। ৩২৭টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। আরও ৫৫০টি আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উপকূলীয় ও বন্যাপ্রবণ এলাকায় ২৩০টি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। ৪২৩টির নির্মাণকাজ চলছে। এ ছাড়া ১৪৮ উপজেলায় ৩৭৮টি মুজিবকিল্লা নির্মাণ করা হয়েছে। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

সর্বশেষ খবর