সোমবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

করোনা: স্বাস্থ্যবিধিতে ছাড় নয়

ডা. অভিষেক ভদ্র

করোনা: স্বাস্থ্যবিধিতে ছাড় নয়

স্বাস্থ্যবিধি মেনেই করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ করা সম্ভব। মাস্ক পরা, বারবার হাত ধোয়া এবং দূরত্ব মেনে চলার বিকল্প নেই। অপ্রয়োজনীয় চলাচল ও ঘোরাঘুরি বাদ দিতে হবে

 

নতুন করে পৃথিবীব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশেও মার্চের প্রথম সপ্তাহের পর পুনরায় সংক্রমণের হার অতিদ্রুত বাড়ছে। বিশ্বের দেশে দেশে যখন আবার লকডাউন, ফ্লাইট বাতিলের পাশাপাশি সীমানা বন্ধের পদক্ষেপ নিচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীর জন্য বেড বা আই.সি.ইউ খালি পাওয়া দুস্কর হয়ে পড়েছে। তাই সময় নষ্ট না করে এখনই সবার ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কারণ একবার আক্রান্ত হয়ে গেলে কিংবা পরিবারের কারো জীবন সংকটাপন্ন হলে, তখন যাকেই দোষ দেন না কেন তাতে কোনই লাভ নেই। তখন ক্ষতি নিজের, ক্ষতি নিজের পরিবারের। 

সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির কারণ: যেকোনো পরিস্থিতিতেই স্বাস্থ্যবিধি মানা করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের পূর্ব শর্ত, কিন্তু আমাদের মধ্যে তার ব্যাপকভাবে শৈথিল্য দেখা গেছে, যা সংক্রমণ বৃদ্ধির একটা বড় কারণ। রাস্তাঘাটে হরহামেশাই মানুষকে মাস্ক ছাড়া দেখা গেছে। মাস্ক থাকলেও তা যথাযথভাবে ব্যবহার করার কোনো  লক্ষণ  অধিকাংশ মানুষের মাঝে নেই। অতি সম্প্রতি গবেষণা সাময়িকী ‘এলসেভিয়ার’-এ প্রকাশিত করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স পরিবর্তন নিয়ে বাংলাদেশি একদল গবেষক ৩৪টি পরিবর্তীত রূপ খুঁজে পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন। দেশে করোনাভাইরাসের যে রূপগুলো পাওয়া গেছে, তার সঙ্গে ইউরোপের এবং আমেরিকান ধরনগুলোর মিলই বেশি। বলা হচ্ছে, করোনাভাইরাসের নতুন রূপটি আগের চেয়ে অধিক সংক্রামক। অর্থাৎ অতি দ্রুত মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে এবং মানুষকে আক্রান্ত করছে।

যারা ইতিমধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছেন, তারা অনেকেই মনে করছেন, তাদের আর করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সুতরাং তারা বেশ হেলাফেলা এবং নিশ্চিন্ত মনে দিনযাপন করছেন। কিন্তু সত্য হচ্ছে, চারপাশে অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে দ্বিতীয়বার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যমতে, একবার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবার পর যদি শরীরে যথাযথ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়, তাহলে গড়পড়তায় তিন থেকে ছয় মাস সুরক্ষা পাওয়া যায়। এ সময়ের পরে কেউ আবারো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন। আরও আশঙ্কার বিষয়, দেখা গেছে যারা দ্বিতীয়বার করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়েছেন তাদের জটিলতার মাত্রা বা তীব্রতা কিন্তু প্রথমবারের চেয়ে অনেক বেশি। তাই প্রাণহানির ঝুঁকি অনেক বেশি।

দেশে ইতিমধ্যে সফলভাবে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রদান করা শুরু হয়েছে। যারা ভ্যাকসিন নিয়েছেন তাদের অনেকেরই মনে কাজ করছে, ‘আমি যেহেতু ভ্যাকসিন নিয়েছি সুতরাং আমি নিরাপদ। তাই মাস্ক বা স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলাচল করতে পারব।’  আসলে এ ধারনাটি সম্পূর্ণ ভুল।  কারণ, ১ম ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়ার পর শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হতে অন্তত ১৪ থেকে ২১ দিন সময় লাগে।  তাছাড়া ২য় ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়ার পর অর্থাৎ পরিপূর্ণ ভ্যাকসিন গ্রহণ করার পরও তা কিন্তু করোনা প্রতিরোধের শতভাগ নিশ্চয়তা দেয় না। সুতরাং প্রথম বা দ্বিতীয় ডোজ যাই হোক না কেন, ভ্যাকসিন গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা বিশেষ করে মাস্ক পরার ব্যাপারে কোনো রকম আপস বা ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।

মাস্ক নিয়ে হেলাফেলা নয় : ঘরের বাইরে গেলে অবশ্যই মুখে সঠিকভাবে মাস্ক পরতে হবে। বারবার হাত ধোয়ার ও হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মানার অভ্যাস করুন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে যে শিথিলতা চলছে, তা অবশ্যই দূর করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে জরুরি ভিত্তিতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

অযথা ঘোরাঘুরি নয় : অপ্রয়োজনে বাইরে যাবেন না, কাজ শেষে দ্রুত বাড়ি ফিরে আসুন। শিশুদের নিয়ে অকারণে বাইরে যাবেন না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনো বন্ধ রাখা হয়েছে শিশু-কিশোরদের স্বাস্থ্যের কথা ভেবেই। শিশুরাও নীরব বাহক হিসেবে ভাইরাস ছড়াতে পারে।

টিকা নিতে হবে :  নিজে টিকা নিন এবং অন্যকে নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করুন। বর্তমানে দেশে যে টিকা দেওয়া হচ্ছে, সেটির ১ম ডোজ নেওয়ার ন্যূনতম ১৪-২১ দিন পর থেকে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি শুরু হয়। তাই এ সময়েও যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে করোনায় সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। সুতরাং টিকা নেওয়ার আগে ও পরে স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপরে কোনোরূপ ছাড় দেওয়া যাবে না।

লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত সতর্ক হোন : অসুস্থ বোধ করলে, জ্বর, কাশি বা গলা ব্যথা, স্বাদ হীনতাসহ করোনার কিছু নতুন লক্ষণ যেমন: ক্লান্তি, ক্ষুধামন্দা, মাথাব্যথা, ডায়রিয়া, মানসিক বিভ্রান্তি, গলাব্যথা, পেশিব্যথা, ত্বকে র‌্যাশ, হাত ও পায়ের আঙুলের রং বিবর্ণ হওয়া ইত্যাদি দেখা দিলে উপসর্গ যত মৃদুই হোক, নিজেকে সবার কাছ থেকে আলাদা করে ফেলুন। পরীক্ষা না করা বা চিকিৎসকের পরামর্শ না নেওয়া পর্যন্ত বের হবেন না। এ সময় বাড়ির সবার কাছ থেকেও দূরে থাকুন। অনেকেরই মৃদু উপসর্গ হচ্ছে, আর তা নিয়েই সবাই বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, যা আরও ভয়ঙ্কর। সুতরাং সাবধান হোন।

বিদেশ থেকে আসলে নিজ দায়িত্বে কোয়ারেন্টাইন থাকুন: বিদেশ থেকে যারা আসছেন, তাদের সবাইকে পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক অথবা ব্যক্তিগত উদ্যোগে দুই সপ্তাহ সবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হবে, যাতে করে ভাইরাসের নতুন নতুন ধরন দেশে ছড়াতে না পারে।

আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, শুধুমাত্র স্বাস্থ্যবিধি মেনেই করোনা ভাইরাসের প্রতিরোধ করা সম্ভব। মাস্ক পরা, বারবার হাত ধোয়া এবং দূরত্ব মেনে চলার বিকল্প নেই। অপ্রয়োজনীয় চলাচল ও ঘোরাঘুরি বাদ দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার পূর্বে এখনই আমাদের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। সরকার কি পদক্ষেপ নিল কিংবা আমাদের চারপাশের মানুষ জন কি করল বা না করল তা ভেবে সময় নষ্ট করা উচিত হবে না।  বরং সচেতনতা এবং স্বাস্থ্যবিধি মানার দায়িত্ব নিজের কাঁধেই নিতে হবে। তাই এ বিষয়ে সচেতন হোন।

লেখক : প্রভাষক, পপুলার মেডিকেল কলেজ, ঢাকা

সর্বশেষ খবর