বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।
চূড়ান্ত এই তালিকায় বাদ পড়েছেন ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ মানুষ। ফলে তাদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত।
প্রকাশিত এনআরসিতে জায়গা পেয়েছেন ৩ কোটি ১১ লাখ ২১ হাজার ৪ জন।
শনিবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় (বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ১০টা) এই তালিকা প্রকাশ করা হয়।
এনআরসির পেছনের কারিগর কে এই প্রদ্বীপ কুমার?
আসামের এনআরসি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চললেও এর পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যার তাকে অনেকেই চেনেন না। তার নাম প্রদ্বীপ কুমার ভূঁইয়া। বর্তমানে তার বয়স ৮৪ বছর। বাড়ি রাজ্যের গোয়াহাটিতে। তিনি ১৯৫৮ সালে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি খারাগপুর (Indian Institute of Technology Kharagpur) থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন।
যদিও এর আগে তিনি কখনোই এনআরসি নিয়ে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হননি। সময় নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’কে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন প্রদ্বীপ কুমার।
কীভাবে এনআরসির ভাবনা মাথায় আসল?
প্রদ্বীপ কুমার: ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে একদিন এনজিও আসাম পাবলিক ওয়ার্কের কর্মকর্তা অভিজিত শর্মা আমার কাছে এই অনুরোধ নিয়ে আসলেন। তিনি বললেন যতই দিন যাচ্ছে আসামে অবৈধ অভিবাসী মহামারী আকার ধারণ করছে, অথচ এনআরসি ইস্যুটা অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। এ সময় তিনি আমাকে এই বিষয়ে আদালতে একটি পিটিশন করার জন্য বলেন।
তখন আমার মাথায় একটা বিষয় আসে যে, যদি আমরা এটাকে প্রতিষ্ঠা করতে চাই তাহলে আমাদের কিছু তথ্য-উপাত্ত দরকার। আমাদের দেখানো দরকার যে, গত কয়েক বছরে কীভাবে ভোটার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে। তখন আমি তাকে বললাম- ১৯৭১ সাল থেকে শুরু করে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত সর্বশেষ ভোটার তালিকাসহ ডকুমেন্টগুলো এনে দাও। এর পরবর্তীতে দুই মাস ধরে আমি সেগুলো নিয়ে কাজ করি। দশক ধরে ধরে আমি পার্থক্যগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করি।
২০০৯ সালের জুলাইতে আমি সুপ্রিম কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা (Public Interest Litigation-PIL) দায়ের করি। অভিজিত চেম্বারের ভেতরে ছিল। আমি ছিলাম বাইরে। আসলে আমি বাইরে প্রার্থণা করছিলাম যাতে মামলাটি গৃহীত হয়। কেননা, মোটামুটি ৬০ শতাংশ পিআইএল মামলাই প্রত্যাখ্যান করা হয়। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে, ভারতের তৎকালীন প্রধানবিচারপতি আমাদের মামলাটি গ্রহণ করে নোটিস জারির আদেশ দেন।
অভিজিৎ এবং আসাম পাবলিক ওয়ার্কসই এই পিটিশনের পরিচিত মুখ। আপনি কেন নিজেকে আড়াল করে নিলেন?
প্রদ্বীপ কুমার: আমি নিজেও বিষয়টি নিয়ে ভাবতাম। যখন কেউ একজন অনুরোধ নিয়ে আসল তখন বিষয়টি নিয়ে সামনে অগ্রসর হই। কেননা, আমাদের সময় অনেকের মতো আমিও আসাম আন্দোলনে অংশ নিয়েছি। আমিও এটাকে প্রবলভাবে অনুভব করতাম। সেই তাড়না থেকেই কাজটা করা। আমি দেখলাম, রাজ্যের রাজনৈতিক শক্তি চলে যাচ্ছে অভিবাসীদের হাতে। তাই, বিষয়টি নিয়ে অগ্রসর হই।
তাহলে এনআরসি দিয়ে আপনি কী অর্জন করবেন বলে আশাবাদী?
প্রদ্বীপ কুমার: সরকার তো এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন যারা তালিকায় বাদ পড়বেন তাদের এখনই বিতাড়িত করা হবে না। বরং তারা ট্রাইব্যুনালে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করবেন। সেখানে না হলে হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টেও যেতে পারবেন। এর মানে হল- ভারত সরকার কাউকেই বিতাড়িত করতে চায় না। এমন উদ্দেশ্য সরকারের নেই।
তবে আমি মনে করি যতক্ষণ পর্যন্ত যতদিন আইনি প্রক্রিয়া চলমান থাকবে ততদিন তাদের ভোটাধিকার স্থগিত করা উচিত। তারা অন্যসব কাজ স্বাভাবিকভাবে করবে, জীপনযাপন করবে, এতে কোনও সমস্যা নেই। কেননা, ভাষা, সংস্কৃতি কিংবা জনসংখ্যা বৃদ্ধি নয়, মূল হুমকি ছিল রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ দখল। সুতরাং তাদের ভোটাধিকার স্থগিত করতে হবে।
অনেকেই এমনকি আসাম পাবলিক ওয়ার্কসেরও অনেক কর্মকর্তা এই তালিকাকে ত্রুটিপূর্ণ বলছেন?
প্রদ্বীপ কুমার: ভারত একটি গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে যেকোনও ব্যক্তি তার স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করতে পারেন। এটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে আমি একটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই, সেটা হল- বহু সংখ্যা বাংলাদেশি নাগরিক, যারা ১৯৭১ এর যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আসামে এসেছে, সনাক্ত হওয়ার ভয়ে তারা এনআরসিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য আবেদনই করেনি। সম্প্রতি গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী এই সংখ্যা ১০ লাখ। তবে ১৯৮১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত নির্বাচনের ভোটারের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে আমার তৈরি হিসাব মতে এ সংখ্যা আরও বেশি। সরকারের উচিত এই গুপ্ত (Ghost) নাগরিকগুলোকে খুঁজে খুঁজে বের করা।
সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
বিডি প্রতিদিন/কালাম