ভারতের জাতীয় সঙ্গীত 'জনগণমন অধিনায়ক'-র বেশ কিছু শব্দ পাল্টে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন বিজেপি নেতা ও সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুব্রহ্ম্যণম স্বামী, আর তার সেই প্রস্তাব নিয়ে বিতর্কও চরমে পৌঁছেছে।
তিনি বলছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা এই গানটির কিছু অংশ বদলে দিয়ে সেখানে সুভাষচন্দ্র বোসের নেতৃত্বাধীন আজাদ হিন্দ ফৌজ গানটি যে আকারে গাইত সেটি ব্যবহার করা উচিত।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার এই দাবি-সংবলিত চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার করার পর স্বামী এখন বলছেন, আগামী ২৩ জানুয়ারি সুভাষ বোসের জন্মবার্ষিকীর আগেই এই পরিবর্তন বাস্তবায়িত হোক।
ভারতে ইতিহাসবিদ ও গবেষকরা অবশ্য অনেকেই জাতীয় সঙ্গীতে কোনও পরিবর্তন আনার পক্ষপাতী নন, এই মুহূর্তে এই বিতর্ককে অপ্রাসঙ্গিক বলেও মনে করছেন তারা।
বস্তুত রবীন্দ্রনাথের লেখা যে জনগণমন অধিনায়ক গত একাত্তর বছর ধরে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত, সুব্রহ্মণ্যম স্বামী তাতে পরিবর্তন আনার দাবি জানাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরেই।
ভারতের এই সুপরিচতি রাজনীতিবিদ, আইনজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদ বর্তমানে বিজেপির রাজ্যসভা এমপি।
গত ১ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী মোদীকে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলেন, সুভাষ বোসের আইএনএ বাহিনী বা আজাদ হিন্দ ফৌজ ১৯৪৩ সালের ২১শে অক্টোবর ইম্ফল দখল করে ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণার সময় 'জনগণমন'-র যে রূপটি গেয়েছিল, সেটিকেই ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।
''জনগণমন অধিনায়ক'' কথাগুলো কার উদ্দেশে বলা, সেই অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্কেরও এতে অবসান ঘটবে বলে ড: স্বামীর দাবি।
গানটি রবীন্দ্রনাথ তৎকালীন ব্রিটিশ সম্রাট পঞ্চম জর্জের প্রশস্তিতে লিখেছিলেন কি না, স্পষ্টতই ড: স্বামী এখানে সেই বিতর্কের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।
ড: স্বামী বলছেন, "আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে অবশ্যই রাষ্ট্রবাদ ও স্বাধীনতার ভাবনা প্রতিফলিত হওয়া উচিত।"
"আমাদের কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি বা গণপরিষদ যখন রবীন্দ্রনাথের লেখা গানটিকে জাতীয় সঙ্গীতের স্বীকৃতি দেয়, তখন অধ্যক্ষ রাজেন্দ্রপ্রসাদ কথা দিয়েছিলেন পরে দেশের পার্লামেন্টের এটাতে পরিবর্তন করার অধিকার থাকবে।"
"আর আমি সুভাষ বোসের গৃহীত যে গানটি নেওয়ার কথা বলছি তাতে মূল জনগণমন-র ৯৫ শতাংশ শব্দই অপরিবর্তিত থাকবে।"
"মাত্র ৫ শতাংশ শব্দ বদলালেই যথেষ্ট, আর তা আমাদের দেশের পূর্ণ স্বাধীনতারও পরিচায়ক হয়ে উঠবে।"
প্রধানমন্ত্রী মোদি এই চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার করে জবাব দেয়ার পর ড: স্বামী সেটিও টুইট করেছেন - এবং সুভাষ বোসের আগামী জন্মবার্ষিকীর আগেই এই পরিবর্তন আনার দাবি জানিয়েছেন।
তবে হায়দ্রাবাদে মৌলানা আজাদ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ একরামুল হক বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন জাতীয় সঙ্গীতে বদল আনার দাবির সঙ্গে তিনি মোটেও একমত নন।
ড: হকের কথায়, "নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শের পক্ষে সুব্রহ্মণ্যম স্বামী যে বরাবরই অত্যন্ত সরব, তা আমরা সবাই জানি।"
"রবীন্দ্রনাথের মতো একজন মানবতাবাদী যেভাবে জাতীয়তার সংজ্ঞা দিয়েছেন তাতেও স্বভাবতই তিনি খুব একটা খুশি নন - আর সেখান থেকেই এই বিরোধিতার অবতারণা।"
"এই গান যে ব্রিটিশ সম্রাট পঞ্চম জর্জের প্রশস্তিতে লেখা নয় রবীন্দ্রনাথ নিজেই তা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, ফলে সেটা নিয়ে বিতর্কও অর্থহীন। আমি মনে করি আমাদের জাতীয় সঙ্গীত একদম ঠিকই আছে, এটা বদলানোর কোনও দরকারও নেই।"
ইতিহাসবিদ মহুয়া সরকারও মনে করছেন, দেশ যখন মহামারির মতো বিরাট সমস্যার কবলে তখন জাতীয় সঙ্গীত বদলানো নিয়ে বিতর্কটাই অনভিপ্রেত।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড: সরকার বলছিলেন, "দেশের সামনে এখন অনেক বড় বড় সমস্যা আছে, মহামারিও শেষ হয়নি। এই মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথের গানে শব্দ পাল্টানো নিয়ে মাথা ঘামানোর বিন্দুমাত্র প্রয়োজন নেই।"
পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পক্ষে বেশ কিছুদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে 'বাংলা পক্ষ' সংগঠন - তারাও রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয় সঙ্গীত বদলানোর তীব্র বিরোধিতা করেছে।
ওই সংগঠনের পক্ষ থেকে জারি করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে: "বাঙালি জাতি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রাষ্ট্রীয় সঙ্গীতের এই অপমানের জবাব বাংলা পক্ষর নেতৃত্বে বাঙালি জাতি দেবে, যেখানে বাঙালির শত্রুদের পাবে, সেখানে।"
তারা আরও বলেছে, "হিন্দি সাম্রাজ্যবাদীরা কোন্ গান, কোন্ শব্দকে এবার রাষ্ট্রীয় সঙ্গীত মনে করবে, তাতে বাঙালির কিছু আসে যায় না। আমাদের রাষ্ট্রীয় সঙ্গীত জনগণমন ছিল, আছে ও থাকবে।"
জনগণমন নিয়ে ড: স্বামীর একটা প্রধান আপত্তি হল ওই গানে 'সিন্ধু' শব্দের উল্লেখ আছে - অথচ দেশভাগের পর সিন্ধ প্রদেশ এখন পাকিস্তানে, যেটা আর ভারতের অংশ নয়।
অধ্যাপক একরামুল হক কিন্তু মনে করিয়ে দিচ্ছেন, "রবীন্দ্রনাথ ওই গানে শুধু সিন্ধু-র কথাই বলেননি, 'বঙ্গ' বা তখনকার অবিভক্ত বাংলারও উল্লেখ করেছিলেন।"
"ভৌগোলিক দৃষ্টিতে দেখলে সেই বাংলার দুই তৃতীয়াংশও তো আজ আর ভারতের অংশ নয় - তো সেটা নিয়ে কি ড: স্বামী চিন্তিত নন?"
"আসলে এটা বুঝতে হবে, সিন্ধ আজ ভারতের অংশ না-হলেও সিন্ধি সংস্কৃতি অবশ্যই ভারতের অংশ। আর রবীন্দ্রনাথও তার লেখায় সেই কালচারাল স্পেসটাই বুঝিয়েছিলেন, কোনও সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানা নয়।"
ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপির একটা অংশও মনে করছে, ড: স্বামীর দাবিতে দলের অনেকের সমর্থন থাকলেও পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের মাত্র মাসকয়েক আগে রবীন্দ্রনাথের লেখা গানে হাত দেওয়ার মতো ঝুঁকি নেওয়াটা রাজনৈতিকভাবে মোটেই সমীচীন হবে না। সূত্র : বিবিসি বাংলা
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত