সুদানের সেনাবাহিনী ও শক্তিশালী আধা সামরিক বাহিনীর মধ্যে তুমুল ক্ষমতার লড়াইয়ে রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কমপক্ষে ৯৭ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছে আরও প্রায় ৬০০ জন।
আধা সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ, সেনাপ্রধানের বাসভবন, খার্তুম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন স্টেশনসহ দুটি বিমানবন্দরের দখল নেওয়ার দাবি জানিয়েছে। যদিও আরএসএফের ওই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে দেশটির সেনাবাহিনী।
বর্তমান পরিস্তিতি বলছে, দেশটিতে সংঘর্ষ আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। গৃহযুদ্ধেরও আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। দেশটির অন্যতম গণমাধ্যম আল সুদানির ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ইয়াসির আব্দুল্লাহ বলছিলেন, “দেশ ক্রমে গৃহযুদ্ধের দিকে যাচ্ছে। এখানে পরিস্থিতি সত্যিই সংকটময়। উচ্চপদস্থ সেনাকর্মকর্তারা যদি সংঘর্ষ থামাতে দ্রুত পদক্ষেপ না নেন, তবে আমরা আরেকটি গৃহযুদ্ধের দিকে যাচ্ছি।”
খার্তুমভিত্তিক প্রখ্যাত সাংবাদিক ইসমাইল কুশকুশ বলেন, “দুই বাহিনীর মধ্যকার লড়াই চরম পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, যা পূর্ভাভাস দিচ্ছে দেশ গৃহযুদ্ধের দিকেই যাচ্ছে। খার্তুমের রাস্তা জনশূন্য। মাঝে মাঝে শুধু গুলির শব্দই শোনা যায়। উত্তেজনা আরো বাড়ছে। এর রেশ ক্রমেই ছড়িয়ে পড়েছে দেশের অন্যান্য প্রধান অঞ্চলেও। বলা যায় আমরা গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিতে আছি।”
সুদানের সেনাবাহিনীর জেনারেল কমান্ড এক বিবৃতিতে বেসামরিক নাগরিকদের বাড়ির ভেতরে থাকার আহ্বান জানিয়েছে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে সংঘর্ষ আরও জোরদার হতে পারে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দ্রুত প্যারামিলিটারি বাহিনীর অনুসন্ধানে অভিযান পরিচালনা করবে যুদ্ধবিমান।
কেন এই সংঘাত
আফ্রিকার দেশ সুদানে ২০২১ সালের অক্টোবরে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। দেশটির স্বৈরশাসক ওমর আল বশির ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর থেকেই সামরিক জেনারেলদের পরিচালিত সভরিন কাউন্সিল নামে একটি পরিষদ দেশটিকে পরিচালনা করছে। এ কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল বুরহান।
অন্যদিকে ওই কাউন্সিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট আরএসএফ প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালু। তিনি এক সময় ওমর আল বশিরের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন। সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল দাগালু ‘হেমেতি’ নামে অধিক পরিচিত। সম্প্রতি তিনি সেনাপ্রধান বুরহানকে ‘অপরাধী’ ও ‘মিথ্যাবাদী’ বলে অভিহিত করেন।
এই সভরিন কাউন্সিল চায়, দুই বছরের মধ্যে আধা সামরিক বাহিনী আরএসএফকে মূল সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করতে। তবে আরএসএফ চায় অন্তত আরও ১০ বছর পর প্রক্রিয়াটি শুরু হোক। পক্ষ দুটির সাম্প্রতিক দ্বন্দ্বের মূল কারণ এটিই।
সুদানে বেসামরিক শাসনে ফেরার প্রস্তাবিত পদক্ষেপের মূলে আছে আরএসএফকে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি। কিন্তু এর সময়সূচি নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ গভীর ফাটলকেই সামনে এনেছে।
দাগালুর উত্থান শুরু হয়েছিল এই শতকের প্রথম দশকের গোড়ার দিকে। তখন তিনি দারফুর সংঘাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত কুখ্যাত জানজাওয়েদ বাহিনীর নেতা ছিলেন। ২০১৯ সালে গণতন্ত্রপন্থী শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে গুলি করে কমপক্ষে ১১৮ জনকে হত্যা করেছিল তার দল।
সুদানের সেনাবাহিনী দাগালুর আরএসএফকে দেশের বিরুদ্ধে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করার জন্য অভিযুক্ত করেছে। পাশাপাশি দলটি ভেঙে দেয়ারও দাবি করেছে।
এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, দাগালুর বিদ্রোহী মিলিশিয়াকে ভেঙে দেওয়ার আগে কোনও আলোচনা বা সংলাপ হবে না। দাগালুকে ‘পলাতক অপরাধী’ অভিহিত করে ওয়ান্টেড পোস্টারও জারি করে সেনাবাহিনী।
সুদানের সামরিক বাহিনীর এমন অবস্থানের ফলে দেশটিতে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের ইঙ্গিত মিলছে। কারণ আধা সামরিক বাহিনী হলেও সেনাবাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘকালীন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতা রয়েছে শক্তিশালী প্যারামিলিটারি বাহিনী আরএসএফের।
সংঘাত বন্ধের আহ্বান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস আরএসএফ ও সুদানের সশস্ত্র বাহিনীর নেতাদের অবিলম্বে সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। নিরাপত্তা পরিষদ এক বিবৃতিতে মানবাধিকারসংক্রান্ত কার্যক্রম ও জাতিসংঘের কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের ওপর জোর দিয়েছে।
আফ্রিকান ইউনিয়নও রাজনৈতিক ও সামরিক পক্ষগুলোকে ন্যায্য রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের মিত্রদেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। সূত্র: বিবিসি, সিএনএন, স্কাই নিউজ
বিডি প্রতিদিন/কালাম