বিশ্বাস ও ভূগোলের সীমায় বন্দি থাকে না লোক ঐতিহ্য। শিরনি তেমনই একটি বিষয়। শিরনির অংশীদার জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সবাই। শব্দটি ফারসি, যা মুসলিম সমাজে ‘শিন্নি’ নামে প্রচলিত।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে শিরনির প্রচলন ছিল না, দক্ষিণ এশিয়ার বাইরেও শিরনির প্রচলন নেই। শিরনি পীর-দরবেশের সম্মানে নিবেদিত মিষ্টান্ন, যা চাল-আটা-দুধ-কলা-চিনির তৈরি খাদ্যবিশেষ।
বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বরকত লাভের আশায় শিরনি বিতরণ মুসলমান বাঙালি সমাজের রেওয়াজ। মসজিদ, মাদরাসা, দরগা প্রভৃতি স্থানে শিরনি বিতরণের উদ্দেশ্য হলো, মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনার মাধ্যমে বিপদ-আপদ, রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্তি লাভ করা।
কখনো কখনো সাফল্য বা উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য শিরনি মানত করা হয়। শিরনির কয়েকটি নমুনা—
হুদা ভাত ক্ষীর শিরনি : ঐতিহ্যটি প্রায় ৮০০ বছরের প্রাচীন। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মনুমুখ ইউনিয়নের বাজরাকোনায় শাহ জালাল ইয়ামনি (রহ.)-এর সফরসঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম শাহ মইন উদ্দিন (রহ.)-এর মাজার। প্রতিবছর মাঘ মাসের প্রথম বুধবার রোগমুক্তি ও নানা মনোবাসনায় ধনী-গরিব সবাই সাধ্যানুযায়ী শিরনি হিসেবে মহান আল্লাহর নামে ভাত ও ক্ষীর দেন মাজারে।
এ উপলক্ষে সকাল থেকে কোরআন খতম, খতমে খাজেগান, মিলাদ ও দোয়ার কার্যক্রম চলে। শুধু ভাত হলেও তা খুবই ঘ্রাণযুক্ত এবং খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু। স্থানীয়দের কাছে এটা হুদা ভাতের শিরনি নামে পরিচিত।
মাঘের শিরনি : নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলে ষোড়শ শতকে ঘরবসতি শুরু হলে বাঘের আতঙ্ক থেকে রক্ষার জন্য বাঘাই শিরনির প্রচলন হয়। মাঘের শীতে হাওরে বাঘ নামত।
মেছো বাঘ, চিতাবাঘ বা স্থানীয় ভাষায় টিক্কাপুড়া বাঘ। মানুষ দল বেঁধে মারত এই বাঘ। মানুষের বিশ্বাস, সব ঘরের চাল এক হাঁড়িতে রান্না করলে সেই গ্রামে বাঘ আসে না। কুয়াশাচ্ছন্ন মাঘের রাতে দল বেঁধে শিরনির জন্য চাল তোলা হতো গ্রামীণ মেঠো পথে হেঁটে হেঁটে। ভাটিয়ালি সুর-ছন্দের গানের দলে থাকত বাঘ সাজা যুবক। এ এক লোক উৎসব। প্রায় ১০ দিন চাল সংগ্রহের পর ১৩ মাঘ বা সুবিধাজনক চাঁদনি রাতে সব ঘরের চাল দিয়ে রান্না হতো বাঘের শিরনি বা মাঘের শিরনি। শুধু বাঘের আক্রমণই নয়, হাওরের সমৃদ্ধি কামনা, হাওরে যাতে ধান ভালো হয়, মাছ ভালো হয়, সে জন্যই শিরনি।
ফুল শিরনি : বৃহত্তর সিলেটের কিছু এলাকায় দেশি ফল ও সালাদজাতীয় অন্যান্য সবজি মিশিয়ে ফুল শিরনি নামের তবারক বনানো হয়।
পাঙালদের শিরনি : বাংলাদেশের মুসলিম নৃগোষ্ঠী পাঙালদের আকিকা, চল্লিশা (নুফনি), গর্ভবতী মহিলার খানা (থা মাপ্পাল), বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গরু ও মুরগির মাংসের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী তরকারি ‘য়ামথাকপা’ (হালিমের মতো), ‘এরি’ (মাংসের ঝোল), বার্ষিক শিরনি (কুম), তোসা শিরনি (চিনি-ময়দা-ঘির তৈরি) মাঙাম পরিবেশন করা হয়।
গাঁওয়ালের শিরনি : অনাবৃষ্টি থেকে মুক্তির জন্য পাবনার কিছু এলাকায় গ্রামবাসী মসজিদ বা গ্রামপ্রধানের বাড়ির উঠানে পোলাওয়ের চাল, দুধ, চিনি ও মসলা দিয়ে ‘গাঁওয়ালের শিরনি’ নামের বিশেষ ধরনের পায়েশ রান্না ও বিতরণ করে। শতাব্দীপ্রাচীন লোকবিশ্বাস, গাঁওয়ালের শিরনি বিতরণে বৃষ্টি হয়।
রসের শিরনি : যুগ যুগ ধরে সীতাকুণ্ড উপজেলার মুরাদপুর ইউনিয়নের উত্তর ভাটেরখীল গ্রামে হয় রসের শিরনি। লোকমুখে শোনা যায়, প্রায় ১০০ বছর আগে কলেরায় যখন অনেক মানুষ মারা যাচ্ছিল তখন কেউ একজন স্বপ্ন দেখেন, ওই এলাকার এক কবরস্থানের পাশে পুরনো বটগাছতলায় শিরনি রান্না করে খাওয়ালে মহামারি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। তখন থেকেই রস দিয়ে রান্না হয় শিরনি। রান্নার আগে মসজিদে খতম পড়ানো হয়।
শত শত মানুষের উপস্থিতিতে খেজুরগাছের কয়েক মণ টাটকা রস, বিন্নি ধানের চাল, সাগু, নারকেল, এলাচ, দারচিনিসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের মিশ্রণে রান্না হয় রসের শিরনি। হাজারো মানুষের সাফল্য ও সুস্থতা কামনায় বিতরণ করা হয় শিরনি।
(বি. দ্র. : এই লেখার উদ্দেশ্য মুসলিম বাংলার সংস্কৃতি তুলে ধরা। উল্লিখিত বিষয়ে ইসলামের বিধান তুলে ধরা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। তা ছাড়া লেখাটি একান্তভাবে লেখকের চিন্তাপ্রসূত।—বি. স.)