ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের তিন মেয়াদে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের অধিকাংশ উন্নয়ন প্রকল্পই ঘুরে ফিরে গেছে নির্দিষ্ট ১০ থেকে ১৫ জন ঠিকাদারের হাতে। দেখা গেছে, সক্ষমতার চেয়ে অধিক কাজের ভারে নষ্ট হয়েছে নির্মাণের গুণগত মান, সময়মতো শেষ হয়নি প্রকল্প, বেড়েছে ব্যয়। ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের পর এদের অনেকে কালো তালিকায় উঠে এলেও সওজে পুরনো কাঠামোই এখনো বহাল। ফলে এখনো কিছু ঠিকাদার এককভাবে পেয়ে যাচ্ছেন শত শত কাজ।
আওয়ামী আমলে সওজের অন্যতম ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ছিল ময়েনউদ্দিন (বাঁশি)। প্রতিষ্ঠানটি ২০১১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মোট ৭০২টি কার্যাদেশ পায়, যার চুক্তিমূল্য প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা। আওয়ামী লীগের পতনের পর অর্থাৎ ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি সওজে নতুন করে আরো ৩১৫টি কার্যাদেশ পেয়েছে, যার চুক্তিমূল্য প্রায় ৪০০ কোটি টাকা।
আওয়ামী লীগ আমলের আরেক প্রভাবশালী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মুহাম্মদ আমিনুল হক (প্রা.) লিমিটেড। ২০১১ থেকে ২০২৪ সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি সওজের ৩ হাজার ৮৯৪টি কার্যাদেশ পায়, যার চুক্তিমূল্য ছিল ৪ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা। গত বছরের ৫ আগস্টের পর এ প্রতিষ্ঠানটিও নতুন করে আরো ১৫৪টি কার্যাদেশ পেয়েছে, যার চুক্তিমূল্য ২৩৮ কোটি টাকা।
অবকাঠামো বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একজন ঠিকাদারের পক্ষে একসঙ্গে শত শত প্রকল্প বাস্তবায়ন বাস্তবসম্মত নয়। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, অল্প কয়েকজন ঠিকাদারের হাতে বিপুলসংখ্যক প্রকল্প থাকায় নির্মাণমান হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ, কাজের মান খারাপ হওয়ার পাশাপাশি শেষ হয়েছেও বিলম্বে। অনেক সময় তারা নিজেরা না করে প্রকল্প বিক্রি করে দিয়েছেন অন্যদের কাছে। এর ফলে অবকাঠামোর গুণগত মানে পড়েছে মারাত্মক প্রভাব।
জানা গেছে, সওজের মালিকানায় সারা দেশে সড়ক-মহাসড়ক আছে প্রায় ২২ হাজার ৪১৯ কিলোমিটার। দেশজুড়ে থাকা এ সড়ক নেটওয়ার্ক ঠিকাদারদের দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন এবং নতুন রাস্তা নির্মাণ করে সংস্থাটি। ঠিকাদারি কাজের নিম্নমানের কারণে এ সড়ক নেটওয়ার্কের উল্লেখযোগ্য অংশ বর্তমানে রয়েছে বেহাল দশায়। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রামসহ মহাসড়কটির বিভিন্ন স্থানে রয়েছে অসংখ্য খানাখন্দ। ২০১৭ সালে চার লেনে প্রশস্ত করার পর মহাসড়কটিতে বর্তমানে একটি রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্প চলমান রয়েছে, যাতে ৭৯৩ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। চলমান রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্পের মধ্যেই মহাসড়কটিতে খানাখন্দ দেখা দিয়েছে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক মহাসড়কেও রয়েছে অসংখ্য খানাখন্দ। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা জেলা সড়কগুলোর। চলমান বর্ষায় সড়ক-মহাসড়কগুলো আরো খারাপ অবস্থার দিকে চলে যাচ্ছে।
বেহাল অবস্থায় থাকা এসব সড়কের একটা বড় অংশে উন্নয়ন-রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করেছেন সওজের শত শত কাজ পাওয়া অল্প কিছু ঠিকাদার। তাদের বিরুদ্ধে নিম্নমানের নির্মাণকাজের অভিযোগও উঠেছে বিভিন্ন সময়। দেশের সড়ক-মহাসড়কের বেহাল দশার জন্য এ ঠিকাদারদেরই বেশি দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গুটিকয়েক ঠিকাদারের অনেক বেশি কাজ পাওয়ার যে ব্যবস্থা আওয়ামী লীগ আমলে গড়ে উঠেছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সেই ব্যবস্থাটি ভেঙে দেয়ার ভালো সুযোগ ছিল- কিন্তু আদৌ তা হয়নি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আওয়ামী লীগ আমলে সওজের অন্যতম শীর্ষ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ছিল মোহাম্মদ ইউনুস ব্রাদার্স। নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্ত করে সওজ বিভাগ। তবে আদালত এ সিদ্ধান্ত স্থগিত করায় আবার সওজের দরপত্রে অংশ নিতে শুরু করেছে ইউনুস ব্রাদার্স। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর প্রতিষ্ঠানটি ২০৫টি কার্যাদেশ পেয়েছে, যার চুক্তিমূল্য ৮২ কোটি টাকা।
এদিকে, আদালতের দ্বারস্থ হয়ে ইউনুস ব্রাদার্স কালো তালিকাভুক্ত হওয়া থেকে বেঁচে গেলেও এখনো সওজে কালো তালিকাভুক্ত হিসেবে রয়ে গেছেন আওয়ামী লীগ আমলের প্রভাবশালী কিছু ঠিকাদার। সওজ সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ আমলে শীর্ষ ঠিকাদারদের মধ্যে হাসান টেকনো বিল্ডার্স, রানা বিল্ডার্স, ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স (এনডিই), মোজাহার এন্টারপ্রাইজ, মাসুদ হাই-টেক, তমা কনস্ট্রাকশন, আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনসহ কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বর্তমানে কালো তালিকাভুক্ত অবস্থায় রয়েছে। আওয়ামী লীগের আমলে (২০১১-২৪) এ প্রতিষ্ঠানগুলো সওজে হাজার হাজার কোটি টাকার কার্যাদেশ পায়, যার অনেকগুলো এখনো চলমান রয়েছে।
ভুয়া সনদ দিয়ে দরপত্র প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় সওজ বিভাগ। এ নিয়ে সওজের প্রকৌশলী ও ঠিকাদাররা গণমাধ্যমকে জানান, এ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও তার আত্মীয়-স্বজন, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মীয় শেখ হেলাল, শেখ সেলিম, মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকী, কুমিল্লার সাবেক সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন বাহার, নোয়াখালীর সাবেক সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী, নারায়ণগঞ্জের সাবেক সদস্য শামীম ওসমান, আওয়ামী লীগ নেতা মির্জা আজমসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।
সূত্র : বণিক বার্তা।