মায়ের বকুনি আত্মাভিমানে লেগেছিল, তাই অবৈধভাবে কাঁটাতারের বেড়া টপকে দেশের সীমান্ত পার করে প্রথমে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে ছোট্ট সাকিল ওরফে সাকিব। এরপর ট্রেনে কলকাতায় যায়। গত ছয় মাসের বেশি সময় ধরে কলকাতার শিয়ালদহ রেল ষ্টেশন সংলগ্ন এলাকায় একটি মুদি দোকানে কাজ জুটিয়ে নিয়েছিল সে।
কিন্তু হঠাৎই ছন্দপতন ঘটালো করোনা। লকডাউনের জেরে দোকান বন্ধ। কাজ হারা হয়ে পড়ে সাকিল। একমুঠো খাবারের জন্য তখন দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে থাকে সে। একসময় হাইরোড ধরেই কলকাতা ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার ভাঙড় থানার অধীন বারজুলি এলাকায়। অবশেষে খবর পেয়ে তাকে উদ্ধার করে পুলিশ। বর্তমানে ওই জেলারই একটি সরকারি শিশু হোমে ঠাঁই হয়েছে সাকিবের।
জানা গেছে, ছেলেটির বাড়ি বাংলাদেশের চট্টগ্রামের আকবর শাহ পুলিশ স্টেশনের অধীন কোন একটি এলাকায়। বাবা ট্রাক চালক, মা গৃহবধূ। বাড়িতে বাবা-মা ছাড়াও বোন রয়েছে। কিন্তু কোন কারণে মা প্রায়ই তাকে বকাঝকা করতো। তাই বকুনির হাত থেকে রেহাই পেতে বাড়ি থেকে পালিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অঞ্চল পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার হাসনাবাদ দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। এরপর ট্রেনে চড়ে সোজা কলকাতায় আসে সাকিব। গত প্রায় ছয় মাসের বেশি সময় ধরে শিয়ালদহ ষ্টেশন সংলগ্ন একটি মুদির দোকানে কাজ করতো সে। কিন্তু করোনার আবহে ভারতে লকডাউন ঘোষনা হওয়ার পরই দোকানে তালা দিয়ে চলে যান মুদির মালিক। যদিও নিজের দোকানে কাজ করা ওই ছোট্ট বালকটির দায়িত্বও নিতে চায়নি বলে অভিযোগ। এই অবস্থায় কাজ হারিয়ে বালকটি খাদ্য সঙ্কটের মুখে পড়ে। খিদের জ্বালায় এদরজায়-ওদরজায় ঘুরতে থাকে ওই বাংলাদেশি বালক।
একমুঠো খাবারের খোঁজেই বাসন্তী হাইওয়ে ধরে হাঁটতে হাঁটতে কয়েক কিলোমিটার দূরে গত ১৯ এপ্রিল সে পৌঁছে যায় ভাঙড় থানার অধীন ঘটকপুর-চন্ডীতলার বারজুলি গ্রামে। চন্ডীতলায় পৌঁছতেই গ্রামেরই এক মহিলাকে ‘মা’ বলে ডাকে ওই বালক। একসময় ওই মহিলার গলা জড়িয়ে একমুঠো খাবারের জন্য কেঁদে ফেলে সে। প্রাথমিক অবস্থায় ওই গ্রাম্য মহিলাই তার খাবারের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি তার জন্য নতুন পোশাক কিনে দেয় এবং পরবর্তী কয়েকদিন তার বাড়িতেই ওই বাংলাদেশি বালককে আশ্রয় দেন। কিন্তু আইনি জটিলতায় পড়তে পারেন এই ভেবে প্রতিবেশিদের পরামর্শে গত ২৮ এপ্রিল চাইল্ড লাইনের হেল্প নাম্বার ১০৯৮-এ ফোন করেন ওই মহিলা। এরপর দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা চাইল্ড লাইন (সবুজ সংঘ)’এর তরফে যোগাযোগ করা হয় ওয়েষ্ট বেঙ্গল চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির (সিডব্লিউসি) সাথে। বিষয়টি জানানো হয় ভাঙড় পুলিশ থানাকেও। ২৯ এপ্রিল ওই বাংলাদেশি বালককে উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর ওই বালকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে তাকে সিডব্লিউসি’এর হাতে তুলে দেওয়া হয়। পরে সিডব্লিউসি’র নির্দেশে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার রায়দিঘিতে একটি শিশু হোমে স্থানান্তরিত করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে শনিবার ভাঙড় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা চন্দ্রশেখর ঘোষাল বলেন, ‘সাকিল নামে ওই বাংলাদেশি বালকের বাড়ি চট্টগ্রামে। খবর পেয়ে ঘটকপুরের একটি এলাকা থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইতিমধ্যেই উদ্ধারকৃত ওই বালকটিকে একটি সরকারি শিশু হোমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ চাইল্ড লাইন কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে ভিডিও কলের মাধ্যমে ওই বালকের সাথে বাংলাদেশে তার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলানোর ব্যবস্থা করানো হয়েছে।’
শিশু অধিকার রক্ষা নিয়ে কাজ করা দক্ষিন চব্বিশ পরগনা জেলার চাইল্ড লাইন (সবুজ সংঘ)’এর সদস্য শেখ সাদ্দাম বলেন, ‘লকডাউন শেষে সিডব্লিউসি বৈঠকে বসবে এবং সমস্ত নিয়ম মেনে বাংলাদেশ উপদূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করে যত দ্রুত সম্ভব ওই বালককে বাংলাদেশ ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে।’
ইতিমধ্যেই ভাঙড় থানা, সিডব্লিউসি’এর তরফে কলকাতাস্থ বাংলাদেশ উপদূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। লকডাউন পর্ব মেটার পরেই দ্রুতার সাথে সমস্ত আইনি জটিলতা কাটিয়ে ওই বাংলাদেশি বালককে নিজের দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানা গেছে।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল