সুন্দরবনের হিরণ পয়েন্ট, দুবলার চর ও লোনাপানির মাছের খনির মাঝামাঝি বঙ্গোপসাগরের গভীরে জেগে ওঠা বিশাল ভূখণ্ড ‘বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড’। মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ১২০ নটিক্যাল মাইল ও বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন উপকূল দুবলার চর-হিরন পয়েন্ট থেকে ১০ নটিক্যাল মাইল দূরে সাগর গভীরে এই দ্বীপটি বাংলাদেশের আরেক ‘সেন্ট মার্টিন’। বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ডের চারপাশে সমুদ্রের স্বচ্ছ নীল জল, নানা প্রজাতির পাখির কিচিরমিচির শব্দ, সৈকতে আছড়ে পড়া সমুদ্রের ঢেউ, বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ মনকে নিয়ে যায় প্রকৃতির গভীরে। মাইলের পর মাইল দীর্ঘ এই সৈকতে বসে দেখা মেলে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের। প্রায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকত জুড়ে ঘুরে ফিরছে কচ্ছপ, হাজারো লাল রঙের ছোট শিলা কাঁকড়া। স্বচ্ছ নীল জলে ঘুরছে বিভিন্ন প্রজাতির ছোট-বড় সামুদ্রিক মাছ। কখনো কখনো দেখা মিলছে ডলফিনের। এখানকার নীল জলে নেই কোনো হাঙরের আনাগোনা। সৈকতে আছড়ে পড়া ঢেউয়ে শাপরিংয়ের আদর্শ জায়গা। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড যে কোনো দেশি-বিদেশি ইকোট্যুরিস্টের জন্য আর্কষণীয় স্থান। তবে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের এ উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় স্থান বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ডে প্রচার-প্রচারণার অভাবে নেই কোনো দেশি-বিদেশি ইকোট্যুরিস্টের আনাগোনা। রবিবার সরেজমিন বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড ঘুরে দেখা গেছে এমনই চিত্র। দেশের সমুদ্রবিজয়ের পর ব্লু-ইকোনমির কারণে এ দ্বীপটি শুধু প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমিই নয়, জলদস্যু দমন, চোরাচালান প্রতিরোধ ও সমুদ্র-নিরাপত্তায় এটি রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এ লক্ষ্য সামনে রেখে কোস্টগার্ড এই দ্বীপে করতে যাচ্ছে এইটি শক্তিশালী বেজ ক্যাম্প। বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ডে কোস্টগার্ডের বেজ ক্যাম্প নির্মাণ হলে ইকোট্যুরিস্টরা (প্রতিবেশ পর্যটক) নির্বিঘ্নে ঘুরে দেখতে পারবেন বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ডের প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্য। দেড় যুগ আগে জেগে ওঠা দ্বীপটি। প্রকৃতির নিয়মে বছরের পর বছর ধরে বিশাল আয়তন ধারণ করা এ দ্বীপে সরকারি কোনো জরিপ হয়নি এখনো। তবে দ্বীপটির উপকূলে মাছ আহরণে থাকা জেলেদের দাবি, বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড প্রায় ১০ কিলোমিটার লম্বা ও পূর্ব-পশ্চিমে ৮ কিলোমিটার প্রশস্ত। বর্ষা মৌসুমেও বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ডের অধিকাংশ এলাকায় জোয়ারের পানি ওঠে না। এ দ্বীপ ঘুরে দেখা গেছে, প্রাকৃতিকভাবে এখানে জন্মাতে শুরু করেছে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ সুন্দরী, কেওড়া, গেওয়া, পশুর, গরান, ধুন্দল, বাইন, আমুর, টাইগার ফার্নসহ বিভিন্ন লতাগুল্ম ও অর্কিড। এখন এটি রূপ নিচ্ছে ম্যানগ্রোভ বনে। ইকোট্যুরিস্টদের নিরাপত্তা ও সার্বিক বিষয়ে বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ডে কোস্টগার্ড ও ট্যুরিস্ট পুলিশের ক্যাম্প স্থাপনের পাশাপাশি মেডিকেল ক্যাম্প, সুপেয় পানির জন্য প্রয়োজন দিঘি খনন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষায় প্রয়োজন পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার, আধুনিক বার, সুইমিং পুল, শপিং কমপ্লেক্স, হোটেল-মোটেল ও গ্যাংওয়ে নির্মাণ। পর্যটকদের ন্যূনতম এ সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড ইকোট্যুরিস্টদের জন্য হয়ে উঠবে পর্যটনের গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এক যুগ আগে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেরা খুবই ছোট এই দ্বীপটিকে চিনত ‘পুতনির চর’ বলে। বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার শ্রীফলতলা গ্রামের মালেক ফরাজী নামের এক জেলে এ দ্বীপটির নামকরণ করেন বঙ্গবন্ধুর নামে। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা থেকে মালেক ফরাজী ওই দ্বীপটির নাম ‘বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড’ একটি সাইনবোর্ডে লিখে এনে টানিয়ে দেন। এর পর থেকে দ্বীপটির নাম হয়ে যায় বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড। বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড উপকূলে মাছ আহরণে থাকা একাধিক জেলের কাছ থেকে জানা গেছে এ তথ্য। কোস্টগার্ডও তথ্যটি নিশ্চিত করেছে। তিন বছর আগে মারা যাওয়া মালেক ফরাজীর ‘বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড’ এখন গুগল মানচিত্রেও স্থান করে নিয়েছে।
মংলা কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের তত্ত্বাবধানে বাগেরহাট ও খুলনার কয়েকজন সাংবাদিককে নিয়ে যাওয়া হয় বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ডে। কোস্টগার্ডের পেট্রোল বোট কেবিন ক্রুজারে করে মংলা কোস্টগার্ড ঘাঁটি থেকে বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ডে যেতে সময় লাগে তিন ঘণ্টা। সাংবাদিকদের ঘুরিয়ে দেখানো হয় বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড ও কোস্টগার্ডের বেজ ক্যাম্পের প্রস্তাবিত জায়গা। মংলার কোস্টগার্ডের পশ্চিম জোনের স্টাফ অফিসার (গোয়েন্দা) লেফটেন্যান্ট এ এম রাহাতুজ্জামান এ সময় বলেন, গভীর সমুদ্রে মংলা বন্দরের দেশি-বিদেশি জাহাজের নিরাপত্তা, চোরাচালান প্রতিরোধের পাশাপাশি ট্যুরিস্ট, জেলে-বনজীবীদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে এ দ্বীপে কোস্টগার্ডের বেজ ক্যাম্প নির্মাণ করা হবে। এটি নির্মিত হলে দেশি ও বিদেশি জাহাজের নিরাপত্তা মনিটরিং সহজ হবে। রাডারের মাধ্যমে সমুদ্র উপকূলে ব্লু ইকোনমি জোনে নিরাপত্তা দেওয়া হবে সহজতর।