মঙ্গলবার, ১৪ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

‘আর কি হবে এমন মানব জনম, বসব সাধুর সনে’

লালন মেলা

জহুরুল ইসলাম, কুষ্টিয়া


‘আর কি হবে এমন মানব  জনম, বসব সাধুর সনে’

‘হেলায় হেলায় দিন বয়ে যায়, ঘিরে নিল কালে, আর কি হবে এমন মানব জনম, বসব সাধুর সনে’—মাগুরার প্রবীণ বাউল ইদ্রিস আলী একতারার সঙ্গে তাল মিলিয়ে একমনে গেয়ে চলেছেন মরমি সাধক ফকির লালন সাঁইয়ের এই গান। তবে গান নয়, যেন তার কণ্ঠে বিলাপ ঝরে পড়ছে। তিন দিনের লালন স্মরণোৎসব শেষ হচ্ছে। বিদায়ের ঘণ্টা বাজছে। তাই হয়তো এই একনিষ্ঠ লালনভক্তের গলা থেকে এমন বিষাদ ঝরছে। বাউলসাধক সাধু গুরুদের বেশির ভাগ এরই মধ্যে আখড়া বাড়ি ছেড়ে গেছেন। শনিবার শুরু হয় কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে তিন দিনের লালন স্মরণোৎসব। গতকাল রাতে সমাপনী আলোচনা সভা ও সংগীতের মধ্য দিয়ে শেষ হয় এ আয়োজন। জীবদ্দশায় মরমি সাধক ফকির লালন সাঁই দোলপূর্ণিমা তিথিতে শিষ্যদের নিয়ে সারা রাত গান-বাজনা ও তত্ত্বকথা আলোচনা করতেন। সেই ধারা আজও ধরে রেখেছেন তার অনুসারী বাউল-বৈষ্ণবরা। এবারের উৎসবে যোগ দিতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে হাজার হাজার বাউল উৎসব শুরুর কয়েক দিন আগে থেকেই জড়ো হয়েছিলেন ছেঁউড়িয়ার লালনধামে। নির্লোভ, নিরহংকার, সহজ-সরল এই মানুষগুলো আধুনিক সামাজিক লোকাচারের বাইরে থেকে ঈশ্বরকে পাওয়া আর আত্মসুদ্ধির সাধনা করেন বাউলতীর্থ ছেঁউড়িয়ায় এসে। ভাবগান আর বাউল আচারের যজ্ঞ পালন ছাড়াও বাউল পথ ও মতের দীক্ষাও নিচ্ছেন অনেকে। স্মরণোৎসব মানেই বাউল ফকিরদের মহাসম্মেলন। এখানে আগত বাউলরা ভাবপরম্পরা বিনিময় করেন আপন মনে, নিজস্ব রীতিতে। গুরুবাদী এ ধর্মে বিশ্বাসীদের কাছে গুরুই সব। গুরুর নির্দেশিত পথে সাধন-ভজন এবং রস আস্বাদনের সব পথই উন্মুক্ত। আর এই যজ্ঞ সম্পাদনের মধ্য দিয়েই সীমার মাঝে অসীম খুঁজে ফেরেন এ মতে বিশ্বাসীরা। ‘মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই কুল হারাবি, মানুষ ভঁজলে সোনার মানুষ হবি, ‘সত্য বল সুপথে চল’, ‘এলাহি আলামিন গো আলা বাদশা আলমপনা তুমি’, ‘বাড়ির পাশে আরশি নগর’—এ রকম অসংখ্য লালনসংগীতের সুরের মূর্ছনায় তারা মাতোয়ারা করে তোলেন বাউলধাম। এ ছাড়া লালন মাজারের আশপাশে ও মরা কালী নদীর তীর ধরে বাউলেরা ছোট ছোট আস্তানা গেড়ে সাঁইজিকে স্মরণ করেন তার গাওয়া গান গেয়ে। ধামের পাশে বিশাল মাঠের খোলা প্রান্তরে গুরু-শিষ্যের মিলনমেলায় মনের মানুষের সন্ধানে আকুল ভক্তদের চলছে নাচে-গানে দিন-রাত ভাবের খেলা। লালন আখড়াবাড়ি তাদের কাছে পরম ভক্তির তীর্থস্থান। উৎসব শেষে গতকাল বাড়ি ফেরার সময় তাই তাদের কণ্ঠে বিষাদের সুর বেজে ওঠে। নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা প্রবীণ বাউল আলম শাহের কাছে বিদায়বেলার অনুভূতি জানতে চাইলে বলেন, ‘সাঁইজির চরণতলে কটা দিন পড়ে ছিলাম। এখন বিদায়ঘণ্টা বেজে গেছে। কিন্তু মন তো চাইছে না বাড়ি ফিরতে। আরও কটা দিন থেকে যেতে পারলে ভালো হতো। মনটা কেমন করছে, আর যদি আসতে না পারি কোনো দিন!’ আরেক বাউল ইসলাম শাহ বলেন, ‘বাবা, বাড়ি ফিরতে মন চাইছে না। ভাবছি আরও কটা দিন গুরুধামে থেকে যাব।’ মহিলা বাউল করিমন খাতুন বলেন, ‘বাবা, বাড়ি ফিরে যাচ্ছি ঠিকই কিন্তু মনটা পড়ে রইল আখড়াবাড়িতে। এখন থেকেই ফাল্গুনের দোল উৎসবের প্রহর গুনতে থাকব।’

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর