“এত ক্ষণে” -অরিন্দম কহিলা বিষাদে-/“জানিনু কেমনে আসি লক্ষ্মণ পশিল/রক্ষঃপুরে! হায়, তাত, উচিত কি তব/এ কাজ, নিকষা সতী তোমার জননী,/সহোদর রক্ষঃশ্রেষ্ঠ? শূলীশ¤ভুনিভ/কুম্ভকর্ণ? ভ্রাতৃপুত্র বাসববিজয়ী?/নিজগৃহপথ, তাত, দেখাও তস্করে?...”
অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যের এই অংশটি অনেকেরই মুখস্থ এবং বহু শ্রুত। ‘মেঘনাদ বধ’ মহাকবি মাইকেলের প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দের কাব্য নয়। এই ছন্দে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’। শুধু তাই নয়, এটিই বাংলা সাহিত্যের প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দের কাব্য। বাংলায় অমিত্রাক্ষর ছন্দ, সনেট, সর্বোপরি আধুনিকতার প্রবর্তক মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের শৈশব, কৈশোরের বড় একটি অংশ কেটেছিল যশোরের কেশবপুর উপজেলার নিভৃত পল্লী সাগরদাঁড়ি গ্রামে। ‘দুগ্ধস্রোতরূপী’ কপোতাক্ষ নদের কোলে এই গ্রামেরই সম্ভ্রান্ত দত্ত পরিবারে ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি জন্মেছিলেন তিনি। সাগরদাঁড়িতে শৈশব, কৈশোরের দুরন্ত সময় পার করতে করতেই মাত্র ১৩ বছর বয়সে তাকে কলকাতায় যেতে হয়। সাগরদাঁড়িতে মধুকবির স্মৃতি বলতে এটুকুই। এরপর আর কখনো তার সাগরদাঁড়িতে আসা হয়নি। কোনো কোনো আলোচকের লেখায় পাওয়া যায়, তিনি নিজ ধর্ম ত্যাগের পর একবার সাগরদাঁড়িতে এসেছিলেন, কিন্তু তাকে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তবে এ বিষয়টি নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। ১৩ বছর বয়সে তিনি কলকাতায় যাওয়ার পর জন্মভিটায় আর আসুন বা না আসুন, সাগরদাঁড়ির স্মৃতি কবি জীবনভর বয়ে বেড়িয়েছেন, তা তার বিভিন্ন সৃষ্টি থেকেই স্পষ্ট হয়। সেই সাগরদাঁড়ি গ্রাম, কপোতাক্ষ নদ আর কবির জন্মভিটা আজও টানে দেশ-বিদেশের হাজারো সাহিত্যপ্রেমী দর্শনার্থীকে। বিশাল দত্তবাড়ির একাংশ বিলুপ্ত হয়ে গেছে অনেক আগেই। তবে এর কিছু অংশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর সংরক্ষণ করছে। বাড়িটিতে মধুসূদনের ব্যবহার্য জিনিসপত্রের সংগ্রহও তেমন কিছু নেই। তবে মহাকবি পরিবারের ব্যবহার্য প্রচুর জিনিসপত্র এখানে ভালোভাবে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। যা দেখলে সেই সময়কার কোনো সম্ভ্রান্ত পরিবারের জীবনাচার সম্পর্কে অনুমান করা যায়। প্রতিবছর কবির জন্মদিনে এখানে গ্রামীণ মেলার আয়োজন করা হয়। কেশবপুর উপজেলা প্রশাসন, যশোর জেলা প্রশাসন এবং সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এ মেলায় দেশ-বিদেশের লাখো মানুষের সমাগম ঘটে। মেলায় গ্রামীণ পণ্যের সমাহারের পাশাপাশি প্রতিদিন কবির জীবন ও সৃষ্টি নিয়ে থাকে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
তবে শুধু মেলাতেই নয়, বছরজুড়েই এখানে দর্শনার্থীর ভিড় থাকে। বিশেষ করে শীতের সময় প্রতিদিন অনেক মানুষ এখানে পিকনিক করতে আসেন। তারা পিকনিকের আনন্দ উপভোগের পাশাপাশি মহাকবির জন্মভিটা ও তার পরিবারের ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেখেন। দত্তবাড়ির যে ঘরটিতে কবির জন্ম হয়েছিল, সেটি আজ ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে সে স্থানটি চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। পল্লী কবি জসীমউদ্দীন একবার এই স্থানটির মাটি সারা গায়ে মেখে নিজেকে ধন্য মনে করেছিলেন। কবির সৃষ্টিসমগ্র নিয়ে যদিও এখানে কোনো সংগ্রহশালা হয়নি, পাশে কপোতাক্ষ তীরে জেলা পরিষদের বাংলোয় একটি লাইব্রেরি আছে, যেখানে বিভিন্ন ধরনের ১২০০ বই আছে। জন্মভিটার বিভিন্ন স্থানে আছে কবির একাধিক আবক্ষ মূর্তি। তার বিখ্যাত সব কবিতার একাধিক ফলকও আছে এখানে। ‘দাঁড়াও পথিকবর জন্ম যদি তব বঙ্গে!’ - এপিটাফের প্রতিরূপও রয়েছে এখানে।জন্মভিটা থেকে পশ্চিমে কয়েক কদম হেঁটে গেলেই মধুসূদনের ‘দুগ্ধস্রোতরূপী’ সেই কপোতাক্ষ নদ। এ নদের তীরেই এক ফলকে উৎকীর্ণ আছে কবির বিখ্যাত সনেট ‘কপোতাক্ষ নদ’। সাগরদাঁড়িতে মধুসূদনের নামে বেসরকারি উদ্যোগে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যা সবার জন্য উন্মুক্ত। এসব স্থানে মধুসূদনের পরিবারের অসংখ্য ছবি আছে। কবির কাব্য, নাটক, প্রহসন এবং কবিকে নিয়ে রচিত অনেক বইও আছে এখানে। দত্তবাড়ি পৌঁছানোর ঠিক এক কিলোমিটার আগে রাস্তার পাশেই আছে এক প্রাচীন মসজিদ। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে নির্মিত এ মসজিদে মৌলভী লুৎফুল হকের কাছে ফার্সি ভাষা শিখেছিলেন মধুসূদন দত্ত। এ মসজিদটিও দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে।
যশোর থেকে মণিরামপুর-কেশবপুর হয়ে সাগরদাঁড়ি যেতে দূরত্ব প্রায় ৫১ কিলোমিটার। দত্তবাড়ির আঙিনাতেই পর্যটন করপোরেশনের রেস্টহাউস আছে। পাশেই জেলা পরিষদের ডাকবাংলো এবং কেশবপুরেও উপজেলা ডাকবাংলো আছে। পরিবারসহ কবির জন্মভিটা দেখতে গেলে এসব রেস্টহাউস এবং ডাকবাংলোয় আগে থেকে যোগাযোগ করে গেলে ভালো হয়। তবে মধুপল্লীতে সাপ্তাহিক ছুটি থাকে রবিবার ও অন্যান্য সরকারি ছুটির দিনগুলো। এসব দিনে গেলে বিড়ম্বনায় পড়তে হতে পারে।