শনিবার, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

করোনাকালেও ই-কমার্সে নারীর বাজিমাত

জিন্নাতুন নূর

করোনাকালেও ই-কমার্সে নারীর বাজিমাত

রাজধানীর বাসাবোয় একটি বিউটি পারলার ও লেডিস জিম চালাতেন মৌসুমী আক্তার (৪৫)। করোনাভাইরাস সংক্রমণের আগে ভালোই চলছিল তার ব্যবসা। কিন্তু মহামারীতে অন্য ব্যবসায়ীদের মতো এই নারী ব্যবসায়ীও হোঁচট খান। ব্যবসা বন্ধ হয়ে পড়ায় বেশ কয়েক জায়গায় চাকরির জন্য চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এ সময় এক আত্মীয়ের পরামর্শে ঘরে খাবার বানিয়ে তা হোম ডেলিভারি দেওয়ার উদ্যোগ নেন। এ জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পেজও খোলেন। মাস না যেতেই ভালো অর্ডার পেতে শুরু করেন মৌসুমী। দিন দিন বেড়ে যায় তার ক্রেতার সংখ্যা।

মৌসুমী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, তার বেশির ভাগ ক্রেতাই ব্যাচেলর ও কর্মজীবী নারী। খাবার তৈরিতে শুরুতে তার মায়ের সাহায্য নিলেও অর্ডার বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন রান্নার কাজে আরও চারজন নারীকে রেখেছেন। মাস শেষে এখন তার উপার্জন ভালোই। বিগত কয়েক বছরে দেশের নারীরা ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয় বা ই-কর্মাসে বেশ এগিয়ে গেছেন। বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তারা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন ফেসবুক, ইনস্ট্রাগ্রাম, ইমো ও ইউটিউবে নিজের তৈরি পণ্যসামগ্রীর বিজ্ঞাপন প্রচার করছেন। এতে একদিকে তারা সহজেই ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছে দিতে পারছেন, আবার এই মাধ্যমে তাদের পণ্যের প্রচারে বাড়তি অর্থও খরচ করতে হচ্ছে না। ঘর থেকেই নিজেদের পণ্য ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিতে পারছেন। মহামারীতে এবার চাকরি ও কাজ হারিয়ে অনেক নারীই সংসারের হাল ধরতে অনলাইনে পণ্য বিক্রি করছেন। এ কাজে পরিবারের সদস্যরাও তাদের সাহায্য করছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, শুধু সরকারি পদক্ষেপের ওপর নারী উদ্যোক্তাদের নির্ভর করলে চলবে না। তাদেরও উদ্যোগী হতে হবে। প্রথমেই যে ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করতে হবে এমন নয়। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী একজন নারী অল্প  পরিসরেও ব্যবসা শুরু করতে পারেন। এরপর পণ্য পরিচিতি পাওয়া সাপেক্ষে সেই উদ্যোক্তা ব্যাংক ঋণের জন্য আবেদন করতে পারেন। তবে প্রশিক্ষণ ছাড়া তারা বেশি দূর যেতে পারবেন না। দেখা যায়, অনলাইনে হাজার হাজার পেজ খোলা হলেও একসময় এর অনেকটিই ঝরে যায়।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)-সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে ৩ লাখ মানুষ ফেসবুকের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এর অর্ধেকই নারী। এরা নিজের পণ্য বিক্রির মাধ্যমে মাসে সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মহামারীতে ফেসবুকের মাধ্যমে নারীদের পণ্য বিক্রিও দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে লকডাউনে ঘর থেকে বের না হওয়ার কারণে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারীই এ সময় অনলাইনে পণ্য কেনেন; যা ই-কমার্সের সঙ্গে জড়িত নারীদের জন্য ছিল আশীর্বাদের মতো।

ফেসবুকে নারী উদ্যোক্তাদের বড় পেজ উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) ২০১৭ সালে যাত্রা করে। বর্তমানে এ পেজের সদস্য সংখ্যা ১১ লাখের বেশি। শুধু করোনাকালেই প্রায় ১০ লাখ নারী এ গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হন। এর মধ্যে ৪ লাখ উদ্যোক্তা যাদের কোনো পেজ নেই তারা করোনাকালে উইয়ের সঙ্গে যুক্ত হন। সাধারণত ই-কমার্স ব্যবসায় জড়িত নারীরা ঘরে তৈরি খাবার, পোশাক, গয়না, কসমেটিক্স এবং ঘর সাজানোর পণ্যসহ রকমারি জিনিস বিক্রির সঙ্গে জড়িত। ই-কমার্সের সঙ্গে জড়িত নারী ব্যবসায়ীরা জানান, দেশে এখনো নারীরা ব্যবসার জন্য সহজে ব্যাংক ঋণ পান না। যদিও নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসার সুবিধার্থে সরকার কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় সীমিত। কারণ নারী উদ্যোক্তাদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যকই নিজ ঘর থেকে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এ জন্য তাদের কোনো ট্রেড লাইসেন্সের প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া সহজে ব্যাংক ঋণও পাওয়া যায় না।

ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব)-এর যুগ্মসচিব এবং উইয়ের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান নাসিমা আক্তার নিসা বলেন, ‘মহামারীর দুঃসময়ে সংসারের হাল ধরার জন্য নারীরা এগিয়ে এসেছেন। যে নারী কখনো চিন্তাও করেননি উদ্যোক্তা হবেন সংসারের চাহিদা মেটাতে তিনিও এবার উদ্যোক্তা হয়েছেন। একজন নারী তিনি যে বিষয়ে দক্ষ তা পুঁজি করেই ব্যবসা শুরু করেন। এর মাধ্যমে একজন নারী উদ্যোক্তা নিজের পাশাপাশি আশপাশে আরও অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। মহামারীর শুরুর দিকে যেখানে দেশের সব ব্যবসায় খাত বন্ধ ছিল সেখানে সরকার ই-কমার্সকে জরুরি সেবা হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার পর এ খাতটি সচল ছিল। যার ফলে করোনাকালেও নারীরা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পেরেছেন। নারী উদ্যোক্তাদের ট্রেড লাইসেন্সের জটিলতা নিরসনে একটি অনলাইন নিবন্ধনের প্রস্তাব আমরা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা ভাবছি। মহামারীতে আমরা অনলাইনে উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। সরকারের কাছে আবেদন- যে কোনো প্ল্যাটফরমের মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তাদের দক্ষতা আরও বৃদ্ধির জন্য অনলাইন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করুন।’

সর্বশেষ খবর