রবিবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা
একুশে পদক প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

ভাষার সংগ্রামে রচিত হয়েছিল স্বাধীনতার পথ

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভাষার সংগ্রামে রচিত হয়েছিল স্বাধীনতার পথ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মাতৃভাষার জন্য পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে সংগ্রামের সূচনা করেছিলেন, তার মধ্য দিয়েই রচিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ। গতকাল সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে একুশে পদক-২০২১ প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন অনুষ্ঠানে। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে মন্ত্রিপরিষদের সিনিয়র সদস্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এই পুরস্কার দেন।

অনুষ্ঠানে সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব বদরুল আরেফীন। একুশে

পদকপ্রাপ্তদের সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন প্রান্তে দেশের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানরা ছাড়াও মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।

জাতীয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২১ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের হাতে একুশে পদক-২০২১ তুলে দেওয়া হয়। করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনায় ওসমানী মিলনায়তনে সশরীরে উপস্থিত থাকতে না পেরে আফসোস করেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের জীবনের প্রতিটি স্তরেই কিন্তু আন্দোলন-সংগ্রাম করে সবকিছু অর্জন করতে হয়েছে। কেউ আমাদের সেধে কিছু দেয়নি- এ কথাটা মনে রাখতে হবে। একটি জাতিকে যদি ক্ষতিগ্রস্ত করতে হয় বা তার মেরুদন্ড ভেঙে দিতে হয়, তাহলে তার ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানতে হয়। পাকিস্তানিরা সেই চেষ্টাই করেছিল। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বায়ান্নর আন্দোলন কেবলমাত্র ভাষা আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এ আন্দোলন ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা এই কথাগুলোর মধ্যে পাবেন রাজনৈতিক অধিকার। এটা আমাদের স্বাধীনতাকেই বোঝায়। স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের মৌলিক যে চাহিদাগুলো, সেগুলো পূরণের কথাই তিনি বলেছিলেন। কাজেই তিনি ভাষা আন্দোলন থেকেই কিন্তু একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করে এগিয়ে যান। সেই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের মা-কে মা ডাকার অধিকার পাই, আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বে মাথা উঁচু করে চলবে, সম্মানের সঙ্গে চলবে। কারও কাছে হাত পেতে নয়, আমরা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আত্মমর্যাদা নিয়ে চলব। তিনি বলেন, পাকিস্তানি শাসকরা যখন আমাদের ওপর একটি বিজাতীয় ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল, তখন ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে করাচিতে একটি শিক্ষা সম্মেলন হয়। সেখানেই ঘোষণা হয়েছিল উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু উর্দু কোনো মাতৃভাষা না, আর পাকিস্তান নামে যে দেশটি হয়েছিল, তার জনসংখ্যার ৫৬ ভাগের ওপরেই আমরা বাঙালি। আমাদের ভাষা বাংলা ভাষা। কিন্তু সেই বাংলা ভাষা বাদ দিয়ে বিজাতীয় ভাষা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেই ঘোষণাটা পূর্ববঙ্গে আসার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তখন প্রতিবাদ জানায়। তখনকার যিনি মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীও বলা হতো, তার বাড়ির সামনে গিয়েও তারা সেখানে প্রতিবাদ জানিয়ে আসে। এরপর ১৯৪৮ সালে ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রলীগ নামের সংগঠন গড়ে তোলেন। তারই প্রস্তাবে এই ভাষা আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই কিন্তু মূলত আমাদের স্বাধীনতা অর্জন। কারণ যারা আমাদের ভাষার ওপর আঘাত করেছে, তাদের বিরুদ্ধেই তিনি প্রতিবাদ শুরু করেন। পদকপ্রাপ্তদের অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি মনে করি, এটা শুধু আপনাদের সম্মাননা না, এটা জাতির জন্য সম্মাননা, দেশের মানুষের জন্য সম্মাননা। তিনি বলেন, যারা আমাদের বলতে গেলে রক্ত দিয়ে শুধু মাতৃভাষায় কথা বলা না, আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পথ তৈরি করে দিয়েছিল, আমরা তাদের প্রতি সম্মান জানাই।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। তমদ্দুন মজলিসসহ অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের সবাইকে নিয়ে তিনি প্রথম একটি সভা করেন। সেই সভায় সিদ্ধান্ত হয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলা হবে। সেই সভা থেকেই সিদ্ধান্ত হয়, একটি তারিখ ঘোষণা করে আন্দোলন শুরু হবে। ভাষা আন্দোলন ও এই আন্দোলনে জাতির পিতার ভূমিকার কথা জানার জন্য পাকিস্তানি ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের প্রতিবেদনগুলো নিয়ে প্রকাশিত ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ বইয়ের খ-গুলো পড়ার আহ্বান জানান তিনি।

প্রধানমন্ত্রী ভাষা শহীদ রফিক, জব্বার, সালাম, বরকতসহ সবার আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে বলেন, এই রক্ত দিয়েই রক্তের অক্ষরে নিজের মাতৃভাষায় আমরা কথা বলতে চাই। মা-কে মা বলে ডাকতে চাই। সেই কথাটাই তারা লিখে গিয়েছেন। তারপরও কিন্তু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা হয়নি। ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র রচনা করে সেখানে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি অর্জনের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। ১৯৯৯ সালে এই দিনটির আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির গৌরবময় অধ্যায়ের কথাও স্মরণ করেন তিনি।

পদক পেলেন যারা : ভাষা আন্দোলনে অবদানের জন্য এবার মরণোত্তর একুশে পদক পেয়েছেন- মোতাহার হোসেন তালুকদার (মোতাহার মাস্টার), শামছুল হক, অ্যাডভোকেট আফসার উদ্দীন আহমেদ। শিল্পকলায়, কণ্ঠশিল্পী পাপিয়া সারোয়ার, অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ, সালমা বেগম সুজাতা (সুজাতা আজিম), আহমেদ ইকবাল হায়দার (নাটক), সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী (চলচ্চিত্র), ড. ভাস্বর বন্দোপাধ্যয় (আবৃত্তি) ও পাভেল রহমান (আলোকচিত্র)। মুক্তিযুদ্ধ ক্যাটাগরিতে গোলাম হাসনায়েন, ফজলুর রহমান খান ফারুক, বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দা ইসাবেলা (মরণোত্তর) পদক পেয়েছেন। সাংবাদিকতায় অজয় দাশগুপ্ত, গবেষণায় অধ্যাপক ড. সমীর কুমার সাহা, শিক্ষায় বেগম মাহফুজা খানম, অর্থনীতিতে ড. মীর্জা আবদুল জলিল, সমাজসেবায় প্রফেসর কাজী কামরুজ্জামান, ভাষা ও সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য কবি কাজী রোজী, বুলবুল চৌধুরী ও গোলাম মুরশিদ পদক পেয়েছেন। বিজয়ীরা নিজ নিজ পদক প্রহণ করেন এবং মরণোত্তর পদক বিজয়ীদের পক্ষে তাঁদের পুত্র-কন্যা এবং পরিবারের সদস্যরা পদক প্রহণ করেন। মরহুম শামসুল হকের পক্ষে তাঁর পুত্র গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দা ইসাবেলা (মরণোত্তর)-এর পক্ষে তাঁর পুত্র পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার পুরস্কার গ্রহণ করেন। গোলাম মুরশিদের পুরস্কার গ্রহণ করেন তাঁর এক ছাত্র। পুরস্কার হিসেবে স্বর্ণপদক, সনদপত্র এবং নগদ অর্থের চেক প্রদান করা হয়।

সর্বশেষ খবর