মঙ্গলবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

বিজ্ঞাপন ছিল খুনের সূত্র

মির্জা মেহেদী তমাল

বিজ্ঞাপন ছিল খুনের সূত্র

এনজিও কর্মকর্তা শামীমা আক্তার হ্যাপী হঠাৎ করেই নিখোঁজ। অফিসে যাওয়ার পর তিনি আর বাসায় ফেরেননি। তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। স্বামী মুকুল হোসেন মোল্লা সাভারের একটি প্যাকেজিং কারখানার মালিক। স্ত্রীকে খুঁজে না পেয়ে তিনি পাগলপ্রায়। আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে পরিচিত সবখানে স্ত্রীর খোঁজ করে ব্যর্থ হয়েছেন। থানা পুলিশ করেও স্ত্রীর কোনো খোঁজখবর করতে পারছেন না। ২০১২ সালের ৭ জানুয়ারি শামীমা নিখোঁজ হন। পরদিন মুকুল সাভার থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। স্ত্রীকে না পেয়ে মুকুল হতাশ। কী করবেন, কোথায় যাবেন, কোথায় তার প্রিয় স্ত্রীকে খুঁজে পাওয়া যাবে, কিছুই বুঝতে পারছিলেন না তিনি। অবশেষে তিনি ১৩ ও ২০ জানুয়ারি দুটি পত্রিকায় স্ত্রীর ছবি দিয়ে নিখোঁজ বিজ্ঞাপন দেন। এদিকে কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশের চোখে পড়ে পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপনটি। বিজ্ঞাপনে নিখোঁজ নারীর ছবি দেখে আঁতকে ওঠেন। গত ৭ জানুয়ারি কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ অজ্ঞাত এক নারীর মাথা উদ্ধার করেছিল। কেরানীগঞ্জ থানা ওই নারীর পরিচয় উদঘাটনে কাজ শুরু করে। পত্রিকায় প্রকাশিত ছবির সঙ্গে মাথার চেহারার মিল খুঁজে পায় তারা। তারা সাভার থানা পুলিশকে জানায়। সাভার থানা পুলিশ ও মুকুল ছুটে যান কেরানীগঞ্জ থানায়। বিচ্ছিন্ন মাথাটি দেখেই মুকুলের আর্তচিৎকার আর আহাজারি। মাথাটি তার স্ত্রী শামীমার। পুলিশ এখন খোঁজ করতে থাকে শামীমার দেহের বাকি অংশ এবং খুনিকে। কিন্তু খুনির খোঁজ পায় না পুলিশ। দিন যায় খুনি ধরা পড়ে না। শামীমার পরিবার পুলিশের কাছে ধরনা দিতে দিতে হয়রান হয়ে পড়ে। প্রথমদিকে মুকুলের মধ্যে স্ত্রীর খুনিকে গ্রেফতারের ব্যাপারে যেমন আগ্রহ ছিল, আস্তে আস্তে সেটি কমতে থাকে। এতটাই কমে যায়, যা শামীমার পরিবারের সদস্যদের সন্দেহ হয়। শামীমার খুুনিদের বিষয়ে কথাবার্তা বলতে গেলেই এড়িয়ে যেতে থাকে মুকুল। শামীমার পরিবার মুকুলের হঠাৎ এই পরিবর্তনের বিষয়টি পুলিশকে জানায়। এক সময় পুলিশও তাকে নজরদারিতে রাখে। মুকুলের আচরণ চলাফেরার মধ্যে পুলিশও পরিবর্তন দেখতে পায়। শামীমার খুনিদের বিষয়ে খুব একটা গরজ নেই মুকুলের। বরং এ নিয়ে তিনি আর কিছু করতে চান না বলে পুলিশকে নানাভাবে বুঝিয়ে দেন। কিন্তু পুলিশ খুনিকে গ্রেফতার না করে ছাড়বে না। তারাও প্রায় নিশ্চিত যে, এ খুনের সঙ্গে মুকুল জড়িত রয়েছে। এমন চিন্তা করেই ২৬ জানুয়ারি মুকুলকে পুলিশ গ্রেফতার করে। জেরার মুখে প্রথমদিকে স্বীকার না করলেও এক পর্যায়ে বেরিয়ে আসে খুনের আসল রহস্য। পুলিশ জানতে পারে কীভাবে, কেন শামীমাকে হত্যা করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্ত্রীকে হত্যার কথা এবং লাশ তিন টুকরো করার ঘটনা স্বীকার করেন। তার স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে শামীমার লাশের আরও দুটি টুকরো উদ্ধার করে পুলিশ।

মুকুল জেরার মুখে বলেন, ‘বিয়ের আগে সাভারে নীলুফার নামে এক মহিলার বাসায় সাবলেট থাকতাম। সেখানে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নীলুফার তার স্বামীর সঙ্গে দুই মেয়ে নিয়ে ওই বাসায় বসবাস করতেন। এক পর্যায়ে আমি বিয়ে করে একই এলাকায় বাসা ভাড়া নিই। তখনো আমাদের পরকীয়া চলছিল। নীলুফার আমাকে প্রায়ই বলত, বউ নিয়ে সামনে ঘুরলে তার ভালো লাগে না। সে বলত, এক দিন আমি দুজনকেই খুন করব। ২০১২ সালের ৭ জানুয়ারি শামীমাকে নিয়ে কারখানায় যাই। সে সময় কারখানায় বিদ্যুৎ না থাকায় কর্মচারীদের কেউ ছিল না। কারখানায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আগে থেকে ওতপেতে থাকা নীলুফার আমার স্ত্রীর গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ধরে। এ সময় আমি শামীমার পা মাটির সঙ্গে চেপে ধরি। নীলুফার শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। পরে নীলুফার পরামর্শে গুম করতে লাশ তিন টুকরো করে বস্তায় ভরি। এরপর দুজন ট্যাক্সি করে কেরানীগঞ্জের ইটাভাটা ব্রিজের নিচে ফেলে দিয়ে আসি লাশ।’

বিচার : পরকীয়ার জেরে ঢাকার সাভারে এনজিওকর্মী শামীমা আক্তার হ্যাপী হত্যা মামলায় মুকুল হোসেন মোল্লা ও লাভলী আক্তার নীলুফারকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে আদালত। ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ের সময় আসামি মুকুল কাঠগড়ায় ছিলেন অনেকটাই নির্বিকার। অন্য আসামি নীলুফার শুরু থেকেই পলাতক।

সর্বশেষ খবর