শুক্রবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

টাকার কোডে হাতবদল জাল রুপি

পারিবারিক ধারায় দীর্ঘদিন ধরে অপরাধ করে আসছে চক্র

আলী আজম

টাকার কোডে হাতবদল জাল রুপি

পাকিস্তানে তৈরি ভারতীয় জাল রুপির চালান বাংলাদেশের পাচারকারীদের কাছে হাতবদলে ব্যবহার করা হতো পাসওয়ার্ড। বাংলাদেশি টাকার বিভিন্ন নোটের নম্বরকে পাসওয়ার্ড হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এ জন্য নোটের মাঝখান থেকে ছিঁড়ে একটি অংশ দেওয়া হতো ডিলারের কাছে। নোটের নম্বরসহ বাকি অংশ দেওয়া হতো ক্রেতাকে। ক্রেতা নির্দিষ্ট কোডের ওই ছেঁড়া অংশ নিয়ে গেলেই ডিলার বুঝে যেতেন সঠিক লোকই এসেছে। পরে চুক্তি অনুযায়ী তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হতো জাল রুপির চালান। সম্প্রতি জাল রুপি পাচার চক্রের চার সদস্যকে গ্রেফতারের পর এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের দুটি পরিবারের সদস্যদের ব্যবহার করে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতে জাল রুপি সুপার নোট পাচারের চেষ্টা করে আসা পাকিস্তানি এ চক্রের মূলহোতা করাচিতে থাকা শফি ও তার ছেলে সুলতান। পাকিস্তানি নাগরিক শফি একসময় জাল রুপির কারখানায় কাজ করতেন। এক পর্যায়ে নিজেই ভারতীয় জাল রুপির সুপার নোট তৈরি করা শুরু করেন। বর্তমানে তার ছেলে সুলতানই পুরো সিন্ডিকেটের দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের প্রধান সহযোগী হলেন পাকিস্তানি নাগরিক দানেশ ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত পাকিস্তানি নাগরিক ফজলু ওরফে ফরিদ।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) বলছে, বাংলাদেশে ভারতীয় জাল রুপি পাচারের সিন্ডিকেট তৈরি করতে বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকজন পাকিস্তানিকে পাঠিয়েছে চক্রটি। ২০০৮ সাল থেকে সাব্বির, শেরা, আসলাম ও ফজলুসহ বেশ কয়েকজন পাকিস্তানের নাগরিক বাংলাদেশে এসেছিলেন। চক্রের অন্যতম সদস্য দানেশ বর্তমানে বাংলাদেশেই গা-ঢাকা দিয়েছেন বলে তথ্য রয়েছে পুলিশের কাছে। দানেশ ইতিপূর্বে গ্রেফতার চক্রের আরেক হোতা ফাতেমার স্বামী। এরই মধ্যে এ চক্রের বাংলাদেশি দুই সদস্য হাবিল ও আয়নালকে ধরতে অভিযান চলছে। এই হাবিল ভারতীয় সিন্ডিকেটটি নিয়ন্ত্রণ করেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার বেনীচক গ্রামের আবদুল হকের মেয়ে কাজল রেখা। তারা সাত ভাইবোন। তার মা একসময় মহিলা মেম্বার থাকলেও সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকত। জীবিকার তাগিদে ব্র্যাকের চাকরি নিতে কাজল রেখা ২০০৮ সালে মানিকগঞ্জে পাড়ি জমান। সেখানে দেড় মাস চাকরি করেন তিনি। এরই মধ্যে রাজধানীর পল্টনের কাপড়ের দোকানদার দেলোয়ারের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে ঢাকায় আসেন। দেলোয়ারের পরিচয় ছিল আমান উল্লাহ ও ফজলের সঙ্গে। তারা নিয়মিত দেলোয়ারের দোকানে কেনাকাটা করতেন। তখন আমান উল্লাহ ও ফজল অন্য এক কারবারির মাধ্যমে জাল রুপির কারবারে জড়িত ছিলেন।

এক পর্যায়ে দেলোয়ার কাজল রেখাকে আমান উল্লাহ ও ফজলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলে, জাল রুপি চক্রে যোগ দেন তিনি। তাদের পাকিস্তানি নাগরিক ফজলুর সঙ্গে যোগাযোগ হলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিজেরাই বড় চক্র গড়ে তোলেন। এর মাঝখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাত থেকে বাঁচার কৌশল হিসেবে মালয়েশিয়া থেকে আইন বিষয়ে পড়াশোনাও করেন কাজল রেখা। ২০০৮ সালে আমান উল্লাহর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার কিছুদিন পর তাকে বিয়েও করেন কাজল রেখা।

ভারতে পাচারের জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর ও শিবগঞ্জের উপজেলার মনাকষা, হুদমা, শিয়ালমারা এলাকার সীমান্ত পথ বেছে নিয়েছিল চক্রটি। যেহেতু কাজল রেখার বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে, সেহেতু সীমান্ত এলাকা নিয়ে ভালো ধারণা ছিল চক্রের সদস্যদের। তারা প্যাকেট ভর্তি জাল রুপি কাঁটাতারের বেড়ার ওপর দিয়ে ছুড়ে মারতেন। পরে ভারতীয় চক্র সেগুলো সংগ্রহ করে অন্য এজেন্টদের কাছে দিতেন। অনেক সময় ভারতীয় ফেনসিডিল ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে চালান সরবরাহ করে ফেরার সময় জাল রুপির চালান নিয়ে যেতেন। গরু ব্যবসায়ীদের মাধ্যমেও পাঠানো হতো জাল রুপি। অনেক সময় গরুর মূল্য পরিশোধ করা হতো এই জাল রুপির সুপার নোট দিয়ে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট ডিবি কর্মকর্তারা জানান, ভারতীয় জাল রুপির অর্ডার নেওয়া, আমদানি পণ্যের আড়ালে বাংলাদেশে পাঠানো এবং পাচারের পর টাকা সংগ্রহ করার সামগ্রিক বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের বাসিন্দা গ্রেফতারকৃত নোমানুর রহমানের ভাই পাকিস্তানি নাগরিক ফজলু। তিনি সুলতান ও তার বাবার কাছ থেকে উন্নত মানের জাল নোট সংগ্রহ করে কখনো শুঁটকি মাছ, কখনো মোজাইক পাথর ও অন্যান্য নির্মাণসামগ্রীর বস্তার মধ্যে করে সমুদ্রপথে বাংলাদেশ পাঠান। যে কোম্পানির নামে পাথর বা শুঁটকি মাছ আমদানি করা হতো সেটি ছিল কারাগারে থাকা আবু তালেবের ভাইয়ের নামে। জাল রুপির চালান দেশে আনার দায়িত্ব পালন করতেন আবু তালেবই। জাল রুপি সরবরাহের পর সব কালেকশনের টাকা সংগ্রহ করে কারাগারে থাকা সাইদুরকে দিতেন কাজল রেখার ভাই কেরামত। আমান উল্লাহর কাছ থেকে অর্ডার পেয়ে আবু তালেবের মাধ্যমে সমুদ্রপথে জাল রুপি আসত বালাদেশে। পরবর্তীতে পাচারের কাজ ছিল কাজল রেখা, কেরামত, ফিরোজ ও কিবরিয়ার ওপর। কাজল রেখার ভগ্নিপতি সোনামিয়া, ইয়াদুল ও ইফাজ এ চক্রের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। এ কাজে তাদের সহযোগিতা করতেন নোমানুরের আরেক ভাই সাইদুর ও ভগ্নিপতি শফিকুর রহমান।

ডিবির পুলিশের গুলশান বিভাগের এডিসি মো. কামরুজ্জামান সরদার বলেন, ভারতীয় জাল রুপির পাচার ঠেকাতে আমরা সবসময় তৎপর রয়েছি। গত বছরের নভেম্বরে এই চক্রের অন্যতম হোতা সাইদুর রহমান, ইম্পোর্টার আবু তালেব ও ফাতেমা আক্তার নামে তিনজনকে ৭ কোটি ৩৫ লাখ ভারতীয় জাল নোটসহ গ্রেফতার করা হয়। তাদের সূত্র ধরে সোম ও মঙ্গলবার ধারাবাহিক অভিযানে রাজধানীর ডেমরা ও হাজারীবাগ এলাকা থেকে ভারতীয় জাল নোট তৈরির আন্তর্জাতিক চক্রের আমান উল্লাহ ভূঁইয়া, তার স্ত্রী কাজল রেখা, ইয়াসিন আরাফাত, কেরামত ও নোমানুর রহমান খানকে গ্রেফতার করা হয়। এরই মধ্যে এই চারজনকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ২০০৮ সাল থেকে এই চক্রটি কাজ করছে। গ্রেফতার সাইদুরের দুটি অ্যাকাউন্টে চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা আসত। সেই টাকার ভাগ-বাটোয়ারা করতেন সাইদুর। কাজল রেখা ও নোমানুরের পরিবারের বেশির ভাগ সদস্য জাল রুপির কারবারের সঙ্গে জড়িত। নোমানুরের পরিবারের বেশির ভাগ সদস্য পাকিস্তানেও অবস্থান করেছে বিভিন্ন সময়। এ চক্রের অন্য সদস্যদের আইনের আওতায় আনতে কাজ চলছে।

সর্বশেষ খবর