সোমবার, ৭ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

এটিএমের টাকা হাতিয়ে নিত ওরা

অভিনব কৌশল, দুই শতাধিক বুথ থেকে নিয়েছে ৩ কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক

এটিএমের টাকা হাতিয়ে নিত ওরা

এটিএম বুথের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল ওরা। তবে রক্ষকেরাই অবতীর্ণ হতো ভক্ষকের ভূমিকায়। অভিনব কৌশলে হাতিয়ে নিত এটিএম বুথের টাকা। এ ক্ষেত্রে লোডিং ট্রে-তে টাকা রাখার সময় ১৯টি ১০০০ টাকার নোটের পর রাবার কিংবা কিছু একটা রেখে দিত তারা। কোনো গ্রাহক এটিএম বুথে টাকা উত্তোলনের জন্য এটিএম কার্ড প্রবেশ করিয়ে গোপন পিন নম্বর দিয়ে কমান্ড করলে ওই পরিমাণ টাকা ডেলিভারি না হয়ে পার্সবিনে জমা হতো। পরে সেই টাকা নিজেদের মতো করে সরিয়ে নিত চক্রের সদস্যরা। ক্ষতিগ্রস্ত এমন একটি বেসরকারি ব্যাংক অডিটের পর জানতে পারে পুকুরচুরির এ ঘটনাটি। র‌্যাবের কাছে দ্বারস্থ হলে অভিনব কৌশলে জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকটির দুই শতাধিক এটিএম বুথ থেকে প্রায় ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া এই চক্রের আট সদস্যকে শনিবার দিবাগত রাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন আবদুর রহমান বিশ্বাস, তারেক আজিজ, তাহমিদ উদ্দিন পাঠান ওরফে সোহান, রবিউল হাসান, হাবিবুর রহমান ওরফে ইলিয়াস, কামরুল হাসান, সুজন মিয়া ও আবদুল কাদের। এ সময় তাদের কাছ থেকে দুটি চেকবই, একটি এটিএম কার্ড, চারটি আইডি কার্ড, একটি স্বর্ণের নেকলেস, এক জোড়া বালা, এক জোড়া কানের দুল, একটি আংটি ও নগদ ৯ লাখ ৪১ হাজার ৫৫৫ টাকা জব্দ করে র‌্যাব।

এসব তথ্য জানিয়ে গতকাল দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে ব্রিফিং করেন সংস্থাটির মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, সম্প্রতি একটি বেসরকারি ব্যাংকের অডিটে এটিএম বুথের টাকার বেশ কিছু গরমিল দেখা যায়। ফলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ থার্ড পার্টি আগের প্রতিষ্ঠান জি-৪ সিকিউরিটি গার্ড এজেন্সির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে। নতুন করে গার্ডা শিল্ডের সঙ্গে চুক্তি করে। কিন্তু অনিয়ম ও অর্থের গরমিল বন্ধ হয়নি। ব্যাংক অডিটে বিষয়টি আসার পর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ও থার্ড পার্টি সিকিউরিটি এজেন্সি গার্ডা শিল্ড র‌্যাবের শরণাপন্ন হয়। র‌্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি ও ছায়াতদন্ত শুরু করে। ছায়াতদন্তের একপর্যায়ে র‌্যাব উদঘাটন করে যে, থার্ড পার্টি পরিবর্তিত হলেও টাকা লোডার ও অন্যান্য কারিগরি দলের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ফলে র‌্যাব তদন্ত অব্যাহত রাখে।

কমান্ডার মঈন বলেন, দেশে বিভিন্ন ব্যাংক তাদের এটিএম বুথের ব্যবস্থাপনা থার্ড পার্টি বা আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন করে থাকে। থার্ড পার্টি টাকা স্থাপন, নিরাপত্তা, কারিগরি ত্রুটিসহ নানা বিষয় পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে থাকে। ক্ষতিগ্রস্ত সেই ব্যাংকের বুথে টাকা লোড-আনলোডসহ মেইনটেনেন্সের দায়িত্ব পালন করছে ‘গার্ডা শিল্ড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। আবদুর রহমান নামে একজন সেখানে চাকরি নেওয়ার পর প্রতারণা শুরু করেন। তার নেতৃত্বে ২০ জনের একটি দল আর্থিক প্রতারণায় কাজ শুরু করে। প্রতিদিন ব্যাংকটির বিভিন্ন এটিএম বুথে কৃত্রিম জ্যাম সৃষ্টির মাধ্যমে ৬০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিতেন তারা। বিগত এক বছরে প্রায় ৩ কোটি টাকা একই কৌশলে হাতিয়ে নিয়েছে এই চক্র। সাময়িকভাবে ব্যাংকের গ্রাহক বুথ থেকে টাকা উত্তোলনে ব্যর্থ হয়ে ভোগান্তির শিকার হলেও অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বুথে আটকে যাওয়া টাকা ফেরত পেতেন। তবে শেষমেশ ক্ষতির সম্মুখীন হতো ব্যাংক। এটি ডাচ্-বাংলা ব্যাংক।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি স্বনামধন্য আন্তর্জাতিক ব্যাংক ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে প্রথম এটিএম বুথের ব্যবহার শুরু করে। পরে প্রায় সব ব্যাংকে এর প্রচলন ঘটে। কিন্তু এটিএম বুথ ব্যবহার শুরু হওয়ার পর থেকে বেশ কিছু অভিযোগ আলোচনায় আসে। বিগত সময়ে র‌্যাব এটিএম বুথে ডাকাতি, হত্যা ও অবৈধভাবে কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ উত্তোলনের ঘটনায় দেশি-বিদেশি বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে। একেকটি এটিএম বুথ থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের গ্রাহকরা টাকা উত্তোলন করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে কেবল অভিযোগকারী ব্যাংক ছাড়াও অন্যান্য ব্যাংকও ক্ষতির শিকার হচ্ছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার ব্যক্তিরা পরস্পর যোগসাজশে বেশ কয়েকটি এটিএম বুথ থেকে টাকা আত্মসাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য দিয়েছে। গ্রেফতার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র‌্যাব মুখপাত্র জানান, আবদুর রহমান চক্রের মূল হোতা। তিনি তিন-চার বছর আগে জি-৪ সিকিউরিটিতে চাকরি করতেন। আর্থিক অনিয়ম ও টাকা উধাওয়ের কারণে জি-৪ সিকিউরিটি এজেন্সির সঙ্গে ডাচ্-বাংলার চুক্তি বাতিল হলে গ্রেফতার চক্রের মূল হোতা আবদুর রহমান পুরো চক্রটি নিয়ে নতুন চুক্তিবদ্ধ গার্ডা শিল্ড সিকিউরিটিজ এজেন্সিতে চাকরি নেন। তার দায়িত্বপূর্ণ এলাকা মিরপুর, কালশী, বেনারসি, সেনপাড়া, ইব্রাহিমপুর ও কচুক্ষেত এলাকা। তিনি প্রতিদিন বিভিন্ন এটিএম বুথে কৃত্রিম জ্যাম সৃষ্টির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করে আসছেন। গ্রেফতার অন্য সহযোগীরা কন্ট্রোল রুম, লোডিং, কলিং ও মেনটেনেন্সের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। গ্রেফতার ব্যক্তিরা ব্যাংকের এটিএম বুথে টাকা স্থাপন ও মনিটরিং কাজে নিযুক্ত ছিলেন। তারা ঢাকা শহরের ২৩১টি এটিএম বুথ মেশিনে টাকা লোড করে থাকেন। এসব বুথে টাকা স্থাপনের জন্য ১৯ জন লোডার নিযুক্ত রয়েছেন, যারা প্রয়োজনে বিভিন্ন স্থানে অর্থ পৌঁছে থাকেন। এ ছাড়া কারিগরি-সংক্রান্ত বিষয়ে বেশ কয়েকজন নিয়োজিত থাকতেন।

চক্রের সব সদস্যই শিক্ষিত : এক প্রশ্নে কমান্ডার মঈন বলেন, চক্রটির সবাই শিক্ষিত। তবে বেতন পেতেন ১৪ থেকে ২০ হাজার টাকা। কিন্তু তারা আত্মসাৎকৃত টাকায় বিলাসী জীবনযাপন করতেন। জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, গ্রেফতার আবদুর রহমান, সোহাগ পাঠান, হাবিব ও কামরুল এটিএম বুথে লোডিং, কলিং ও মেনটেনেন্সের কাজ করেন। গ্রেফতার কাদের, সুজন, রবিউল ও তারেক আজিজ এটিএম বুথে শুধু লোডিংয়ে কাজ করেন। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন। এক বছরে ৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ : চক্রটি প্রতিদিন ৬০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত কৃত্রিম জ্যাম তৈরির পর আটকে রেখে আত্মসাৎ করত। এভাবে ৯ মাসে প্রায় ৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে মর্মে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক অডিট রিপোর্টের ভিত্তিতে দাবি করেছে।

কমান্ডার মঈন বলেন, থার্ড পার্টি হিসেবে গার্ডা শিল্ডের দায় ছিল। কারণ তারা লোকবল নিয়োগে অতীতের তথ্য ঘাঁটেনি। শুধু অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়েছে। আর সংশ্লিষ্ট ব্যাংক টাকা লোড-আনলোডের ক্ষেত্রে নজরদারি রাখেনি। ব্যাংকের ও সিকিউরিটি এজেন্সির কারও সংশ্লিষ্টতা পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চক্রে জড়িত পলাতক অন্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

সর্বশেষ খবর