বৃহস্পতিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা
অডিট রিপোর্ট ও পরিচালনা বোর্ডের প্রতিবেদন হাই কোর্টে

অসৎ উদ্দেশ্য নিয়েই জন্ম ইভ্যালির

♦ কোনো আইন-বিধি মানেনি ইভ্যালি ♦ ব্যক্তিসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান সব ক্ষেত্রেই ছিল গোঁজামিল ♦ ভাউচার থাকলেও টাকা গ্রহীতার হদিস নেই ♦ বিনিয়োগকারী ছাড়া কোম্পানি চালানো সম্ভব নয়

আরাফাত মুন্না

অসৎ উদ্দেশ্য নিয়েই জন্ম ইভ্যালির

গ্রাহকদের টাকা নিয়ে প্রতারণা করার অসৎ উদ্দেশ্যেই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির জন্ম হয়েছিল। নিজেদের উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ না থাকলেও ইভ্যালির সিইও মোহাম্মদ রাসেল ও চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন গ্রাহকের টাকায় বিলাসী জীবনযাপন করেছেন। ব্যবসা পরিচালনায় সঠিক জ্ঞান না থাকলেও তারা গ্রাহকের সরল বিশ্বাস পুঁজি করে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। প্রচুর নগদ অর্থ লেনদেন হলেও তার সঠিক গতিপথ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এসব অর্থ পাচার হয়েছে কি না সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তা ক্ষতিয়ে দেখতে পারে। উল্লেখযোগ্য কোনো বিনিয়োগকারী না পাওয়া গেলে ইভ্যালি সচল করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। হাই কোর্টের নির্দেশে গঠিত পরিচালনা বোর্ড ও এর আওতাধীন অডিট ফার্মের প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। পরিচালনা বোর্ডের প্রতিবেদন ও ৩০০৬ পৃষ্ঠার অডিট রিপোর্টের সারসংক্ষেপ বাংলাদেশ প্রতিদিনের হাতে রয়েছে।

গতকাল বোর্ডের ১১ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনের সঙ্গে ইভ্যালির হাই কোর্টের নিয়োগকৃত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহাবুব কবির মিলন ৬ পৃষ্ঠার পৃথক প্রতিবেদন দিয়েছেন। এর সঙ্গে দাখিল করা হয়েছে অডিট রিপোর্টও। বোর্ডের পাঁচ সদস্যের পদত্যাগপত্রও দাখিল করা হয়েছে। বোর্ডের পক্ষে ব্যারিস্টার মোর্শেদ আহমেদ খান হাই কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় প্রতিবেদন ও পদত্যাগপত্র দাখিল করেন। জানা গেছে, স্বনামধন্য অডিট ফার্ম ‘হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানি’ ১৮ সেপ্টেম্বর ৩০০৬ পৃষ্ঠার অডিট রিপোর্ট পরিচালনা বোর্ডের কাছে দাখিল করে। এ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে বোর্ড ১১ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। পদত্যাগের বিষয়ে পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের ওপর দায়িত্ব ছিল কোম্পানির অডিট করা এবং এ কোম্পানি সচল করা যাবে কি না, সে বিষয়ে প্রতিবেদন দেওয়া। আমরা আমাদের কাজ শেষ করেছি। তাই আমরা পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছি। এখন সুপ্রিম কোর্টে অবকাশ চলছে। অবকাশের পর বিষয়টি হাই কোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে উপস্থাপন করা হবে।’

ব্যক্তিসর্বস্ব কোম্পানি : অডিট রিপোর্টে ইভ্যালিকে একটি ব্যক্তিসর্বস্ব কোম্পানি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোহাম্মদ রাসেল একাই কোম্পানির সর্বস্ব ছিলেন। তিনি যেমন ইভ্যালির সিইও, এমডি ছিলেন, আবার তিনিই ছিলেন সিএফও। এ কোম্পানিতে কোনো অ্যাকাউন্টস অফিসার ছিল না। কোম্পানির কার্যক্রম ছিল সম্পূর্ণ এলোমেলো। ইভ্যালির অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নীতি, মানবসম্পদ বিভাগ নীতি, উদ্ভাবনী ব্যবস্থাপনা নীতি, উৎপাদন খরচ এবং বিক্রয়মূল্য নির্ধারণে কোনো নীতি খুঁজে পায়নি অডিটকারী দল। এ ছাড়া ইভ্যালির অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ এবং বাস্তবায়ন নীতি, ক্রয়-বিক্রয় নীতি, তথ্যপ্রযুক্তি ও সাইবার নিরাপত্তা নীতি, প্রকৃত মূলধন নীতি খুঁজে পাওয়া যায়নি বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

ঠিক নেই লেনদেনের নথিপত্র : অডিট রিপোর্টে বলা হয়েছে, মাত্র ১ কোটি টাকা মূলধন নিয়ে ব্যবসা করা ইভ্যালির দৈনিক লেনদেন ছিল কোটি কোটি টাকা। তবে এসব লেনদেনসংক্রান্ত কোনো নথিপত্রই সঠিক পাওয়া যায়নি। নগদ লেনদেনের অনেক ভাউচার পাওয়া গেলেও ওইসব ভাউচারের টাকা গ্রহীতার হদিস পাওয়া যায়নি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সাতটি ব্যাংক হিসাবে ৪ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকার বেশি জমা করা হলেও তা কোথায় কীভাবে সরানো বা ব্যয় হয়েছে তার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া ব্যাংক থেকে ৭৯ কোটি ৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা নগদ উত্তোলন করা হলেও তা কী খাতে ব্যয় করা হয়েছে তার সঠিক হিসাব ইভ্যালিতে পাওয়া যায়নি। ইভ্যালি সঠিকভাবে শুল্ক ও কর পরিশোধ করেনি বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

বেতনের বিষয়ে যথেচ্ছাচারিতা : প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইভ্যালি কোম্পানি আইন বা অন্য কোনো বিধিবিধান মেনে চলেনি। যাদের চাকরি দেওয়া হতো তারা সবাই সিইও রাসেল বা চেয়ারম্যান শামীমার আত্মীয়স্বজন। তাদের অনেক বেশি বেতন দেখানো হতো। যে বেতন দেখানো হতো সেগুলো তাদের প্রকৃত বেতন ছিল না। যেমন চারজনের বেতন দেখানো হয়েছে ১ লাখ টাকা করে। প্রকৃতপক্ষে তাদের বেতন ছিল ৬০ হাজার করে। বেতনের বিষয়ে তারা যথেচ্ছাচারিতা করেছেন।

কার্যকর বিনিয়োগকারী ছাড়া ইভ্যালি সচল সম্ভব নয় : অডিট রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইভ্যালির সম্পদের চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় করেছেন কোম্পানির সিইও রাসেল ও চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন। অথচ তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত কোনো জ্ঞানই ছিল না। হিসাব-নিকাশের বিষয়ে তাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এ কারণে কোম্পানির যেসব হিসাব-নিকাশ পাওয়া গেছে তার অধিকাংশই ভুয়া বা মিথ্যা। কোনো কার্যকর বিনিয়োগকারী ছাড়া ইভ্যালি সচল থাকার কোনো সম্ভাবনাই দেখতে পায়নি অডিট টিম।

কোম্পানি বন্ধ হবে আগেই জানতেন রাসেল-শামীমা : অডিট ফার্মের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ১১ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন হাই কোর্টে দাখিল করা হয়েছে। এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রাহকের সরল বিশ্বাস পুঁজি করে রাসেল-শামীমা দম্পতি প্রতারণামূলক ব্যবসা পরিচালনা করেছেন, যা সম্পূর্ণভাবে অবৈধ ও বেআইনি। অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে যে কোম্পানি কাজ করে, সে কোম্পানি টিকে থাকতে পারে না। হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন করলেও ইভ্যালির কোনো স্বচ্ছতা এবং দায়বদ্ধতা ছিল না। অথচ এ লেনদেনের ওপর ভিত্তি করেই রাসেল ও শামীমা নাসরিনসহ ইভ্যালির পদস্থ কর্মকর্তারা বিলাসবহুল জীবনযাপন করেছেন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইভ্যালি ব্যাংক হিসাব থেকে প্রচুর নগদ টাকা উত্তোলন করলেও সেসব নগদ টাকার গতিপথ আমরা খুঁজে পাইনি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, এত টাকা গেল কোথায়? এর থেকে ধারণা হওয়া স্বাভাবিক, কোম্পানিটি বন্ধ করার অনেক আগেই রাসেল-শামীমার ইভ্যালি নিয়ে পরিকল্পিত প্রস্তুতি ছিল যে, কোম্পানিটি একসময় বন্ধ হয়ে যাবে।

টাকা পাচার হতে পারে : নিজেদের উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ না থাকলেও গ্রাহক ও সরবরাহকারীর টাকা খরচ করেছেন রাসেল-শামীমা। এক কথায় বলা যায়, তারা ‘পরের ধনে পোদ্দারী’ করেছেন। তারা যেভাবে খরচ দেখিয়েছেন এটা গ্রহণযোগ্য নয়। খরচের হিসাবসংক্রান্ত যেসব নথিপত্র ইভ্যালিতে পাওয়া গেছে তার কোনোটাই গ্রহণযোগ্য নয়। এত টাকা লেনদেনের সঠিক কোনো হিসাব না থাকায় স্বাভাবিকভাবেই ধারণা জন্মে, এ টাকা পাচার হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ টাকা পাচার হয়েছে কি না সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুসন্ধান করে দেখা উচিত বলেও মনে করে বিচারপতি মানিকের নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পর্ষদ।

প্রসঙ্গত, ইভ্যালি পরিচালনার জন্য ২০২১ সালের ১৮ অক্টোবর আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের বোর্ড গঠন করে দেন হাই কোর্ট। বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের হাই কোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। মানিক ছাড়াও বোর্ডের অন্য সদস্যরা ছিলেন স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন বিভাগের সাবেক সচিব মোহাম্মদ রেজাউল আহসান, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ফখরুদ্দিন আহম্মেদ এবং কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার খান মোহাম্মদ শামীম আজিজ। সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবীর মিলনকে ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন হাই কোর্ট।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর