শুক্রবার, ২০ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

ধর্ষণের নমুনা খুন হওয়া লাশে

সিআইডির তদন্ত

মাহবুব মমতাজী

পাবনার ঈশ্বরদীতে কিশোরী গণধর্ষণের ঘটনায় ডিএনএ পরীক্ষায় নমুনা পাওয়া গেছে কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলায় খুন হওয়া একটি লাশে। এ নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। বিভ্রান্তিতে পড়েছেন দুই মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা। অথচ ঈশ্বরদীতে গণধর্ষণের ঘটনায় শিশুসহ দুজনের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট থানায় একটি মামলা করেন ভুক্তভোগী কিশোরীর মা।

অভিযুক্ত দুজনের সঙ্গে ধর্ষণের শিকার কিশোরীর ডিএনএ পরীক্ষাতে মিল না পেলেও ২০২১ সালের ২৭ অক্টোবর আদালতে চার্জশিট দিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঈশ্বরদী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হাদিউল ইসলাম। তবে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তারা বলছেন, যে দুজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, তারা ডিএনএ পরীক্ষায় সম্পূর্ণ নির্দোষ।

এদিকে তদন্ত কর্মকর্তা হাদিউল ইসলাম বলছেন, নিহত যে ব্যক্তির সঙ্গে গণধর্ষণের ডিএনএ নমুনা মিলেছে, তিনি কখনই পাবনা কিংবা ঈশ্বরদী এলাকায় আসেননি। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০২০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার দেবীদ্বার থানায় সুহেল (৩১) নামে এক ব্যক্তির খুনের ঘটনায় একটি মামলা হয়। মামলা নম্বর-৫। এতে আসামি করা হয় তারই বড় ভাই ইব্রাহিম (৫০) এবং ভাবি রুজিনা বেগমকে (৩৫)। মামলাটি করেন সুহেলের বোন মরিয়ম বেগম (৩৬)। সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ জানিয়েছে, সুহেল মাদকের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এবং মাদকসেবী ছিলেন। তার দুটি বিয়ে হয়েছিল, দুটিই তালাক হয়েছে। হত্যার প্রাথমিক কারণ হিসেবে তারা জানতে পারেন- ঘটনার দিন তার বড় ভাই বাসায় এসে নিজ স্ত্রীর সঙ্গে সুহেলকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখতে পান। পরে তার ভাবি দাবি করেন, তাকে জোর করে খারাপ কাজে বাধ্য করা হচ্ছিল। এক পর্যায়ে বড় ভাই আঘাত করলে সুহেল তাৎক্ষণিক মারা যান।

ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ২০২১ সালের ৬ অক্টোবর সুহেলের লাশে পাওয়া দাঁত ও রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে সিআইডির ডিএনএ ল্যাবে পাঠায় দেবীদ্বার থানা পুলিশ। পরে এর প্রোফাইল ল্যাবের কোডিস সফটওয়্যারে সংরক্ষণ করা হয়। এর আগে ২০২০ সালের ৩০ মার্চ ধর্ষণের অভিযোগে ঈশ্বরদী থানায় একটি মামলা হয়। মামলা নম্বর-৫১। এতে আসামি করা হয় একই উপজেলার পাশের গ্রামের শান্ত মিয়া ও জাহিদ হোসেন নামে এক কিশোরকে। ওই বছর ১৫ জুন ভুক্তভোগী কিশোরীর আলামত হিসেবে তার কামিজ, টাইস ও রক্ত ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ঢাকায় সিআইডি ল্যাবে পাঠানো হয়। একই সঙ্গে অভিযুক্ত দুজনকেও আলামত সংগ্রহের জন্য ল্যাবে নেওয়া হয়। নমুনা দেওয়ার সময় ভুক্তভোগী কিশোরী ল্যাব কর্মকর্তাদের জানিয়েছিলেন, তাকে কে বা কারা ধর্ষণ করেছেন, তাদের তিনি চিনতে পারেননি। আর ঘটনার সময় তিনি অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে ছিলেন। আলামত পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডিএনএ ল্যাবের অ্যানালিস্টরা সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তাদের জানান, আলামতে প্রাপ্ত বীর্য থেকে মিশ্র ডিএনএ প্রোফাইল পাওয়া যায়। তবে এই ডিএনএ পরীক্ষায় অভিযুক্ত দুজনের সঙ্গে মিসম্যাচ হয়েছে। অর্থাৎ তাদের সঙ্গে ধর্ষণের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। পরে তারা ওই কিশোরীর ডিএনএ প্রোফাইল ল্যাবের কোডিস সফটওয়্যারে সংরক্ষণ করেন। পরবর্তী সময়ে তারা বিশ্লেষণ করে দেখেন, এর সঙ্গে দেবীদ্বারের নিহত সুহেলের ডিএনএ প্রোফাইল মিলে যায়। এ নিয়ে কথা বলতে যোগাযোগ করা হলে সিআইডির ডিএনএ ল্যাবের বিশেষ পুলিশ সুপার ড. নাজমুল করিম খান এ প্রতিবেদককে জানান, ডিএনএ প্রোফাইল ভুল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এটি সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক বিষয়। আর ঈশ্বরদীর ধর্ষণের ঘটনায় যদি মামলায় উল্লেখ করা দুজনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেওয়া হয়, তাহলে ধরা যায় সেই তদন্ত সঠিকভাবে হয়নি। ঈশ্বরদী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হাদিউল ইসলাম এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, তিনি পারিপার্শ্বিক সাক্ষীদের তথ্যে অভিযুক্ত দুজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছেন। আর যে ব্যক্তির সঙ্গে ধর্ষণের ঘটনায় ডিএনএ পরীক্ষা মিলেছে, তিনি ওই ব্যক্তির এলাকা দেবীদ্বারে সরেজমিন গিয়েছেন। সেখানে তথ্য নিয়ে জানতে পারেন যে, তিনি কখনই পাবনা এলাকায় আসেননি। তবে ওই ব্যক্তির অবস্থান নিয়ে প্রযুক্তিগত কোনো বিশ্লেষণ করেননি বলেও জানান হাদিউল ইসলাম। দেবীদ্বার থানার মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মাহবুবুর রহমান খাদিম জানান, সুহেল মিয়ার ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্ট নেওয়ার সময় তিনি জানতে পারেন, পাবনার একটি ধর্ষণের ঘটনায় তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। আর এমনিতে সুহেলের চারিত্রিক কিছু সমস্যাও তিনি তদন্ত করতে গিয়ে জানতে পেরেছিলেন। তিনি ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর এ মামলায় চার্জশিট দাখিল করেছেন। মামলা দুটির নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রী ২০২০ সালের ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় অপহৃত হয়। সারা রাত খোঁজাখুঁজি করেন ওই কিশোরীর মা। পরদিন ভোরে তিনি বাড়ি থেকে কিছু দূরে অচেতন অবস্থায় মেয়েটিকে খুঁজে পান। দ্রুত তাকে নিকটস্থ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একই সঙ্গে পুলিশকে অবহিত করেন তিনি। ঈশ্বরদী থানায় মামলা হলে পুলিশ ধর্ষণের শিকার মেয়েটির বস্ত্র জব্দ করে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে জাহিদ ও শান্তকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তবে এ মামলার আলামতে প্রাপ্ত বীর্যের ডিএনএ প্রোফাইল সুহেলের প্রোফাইলের সঙ্গে মিলে যায়। ২০২০ সালের ৩০ আগস্ট তাকে কুড়ালের হাতল দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়। হত্যার পর লাশ মাটিচাপা দিয়ে লুকিয়ে রাখা হয়। হাদিউল তার দেওয়া চার্জশিটে বলেছেন, স্কুলে আসা-যাওয়ার মধ্যে ওই কিশোরীকে উত্ত্যক্ত করত জাহিদ ও শান্ত। ভুক্তভোগীর জবানবন্দি এবং পারিপার্শ্বিক সাক্ষীর ভিত্তিতে তাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে। প্রথমে জাহিদকে হাজতি হিসেবে পাবনা জেলা কারাগারে এবং শান্তকে শিশু দেখিয়ে যশোর পুলেরহাট শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। পরে রেডিওলজিক্যাল পরীক্ষায় জাহিদও শিশু হিসেবে প্রমাণিত হয় এবং তার বিচার শিশু আদালতে করার জন্য আবেদন করা হয়।

সর্বশেষ খবর