বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

দূষণের হিংস্র থাবায় হুমকিতে নদী

♦ ৫৬ নদীর পানি পরীক্ষায় মিলেছে ভয়াবহ দূষণ ♦ প্রাণী বেঁচে থাকার অক্সিজেন নেই ২৬ নদীতে ♦ বিপন্ন শতাধিক প্রজাতির মাছ ♦ খাদ্যচক্রে বিষ ঢুকছে মানবশরীরে ♦ বাড়ছে কিডনি বিকল, ক্যান্সারসহ প্রাণঘাতী রোগ ♦ ক্ষতি বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকা

শামীম আহমেদ

দূষণের হিংস্র থাবায় হুমকিতে নদী

শীতলক্ষ্যার বিভিন্ন স্থানে অবাধে পড়ছে কারখানার দূষিত পানি -জয়ীতা রায়

দখলের পাশাপাশি ভয়াবহ দূষণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে দেশের নদনদী। ৫৬ নদনদীর পানি পরীক্ষায় সবকটিতেই মিলেছে অতিমাত্রায় দূষণ। এর মধ্যে জলজপ্রাণী বেঁচে থাকার মতো পর্যাপ্ত অক্সিজেন নেই ২৬টিতে। নদীদূষণের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জীববৈচিত্র্য ও জনজীবনে। হারিয়ে যাচ্ছে অনেক মাছ ও জলজপ্রাণী। দূষণের বিষ খাদ্যচক্রের মাধ্যমে প্রবেশ করছে মানবশরীরে, যা জন্ম দিচ্ছে কিডনি বিকল, ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগের। যাচ্ছে প্রাণ। বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে নদনদী দূষণের আর্থিক ক্ষতি প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা।

রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি) গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের ৫৬টি নদনদীর পানি গাজীপুরের গ্রিনবাড ল্যাবে পরীক্ষা করে চলতি মাসে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা গেছে, ৫৬টির মধ্যে ২৬র পানিতে জলজপ্রাণীর সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় দ্রবীভূত অক্সিজেন (ডিও) নেই। ৫৬ নদনদীতেই বিপজ্জনক মাত্রায় প্লাস্টিক ও রাসায়নিক দূষণ রয়েছে। আমেরিকান পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুযায়ী, প্রতি লিটার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন ৫ মিলিগ্রামের নিচে নামলেই মাছসহ জলজপ্রাণীর শ্বাস নিতে সমস্যা হয়। অথচ বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, টঙ্গী খাল, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, লবণদহ, লোয়ার বানার, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, তিতাস, চিলাই, সুতাং, বংশী, হাঁড়িধোয়া, কর্ণতলী নদনদীর পানিতে অক্সিজেন রয়েছে ২ মিলিগ্রামেরও কম। পাঁচটি নদনদীতে রয়েছে ১ মিলিগ্রামের কম। এসব নদনদীর পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতির জন্য দায়ী দূষণ উপাদান বিওডি (বায়োকেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড) ও সিওডি (কেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড) পাওয়া গেছে সহনশীল মাত্রার চেয়ে ৫০ গুণ বেশি। গাজীপুরের লবণদহ নদের পানিতে সিওডি ২১৮ মিলিগ্রাম ও বিওডি পাওয়া গেছে ১১৭ মিলিগ্রাম, যা সহনীয় মাত্রার চেয়ে যথাক্রমে ২১ ও ৫৮ গুণ বেশি। দূষণের কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়েছে শিল্পবর্জ্য, পৌরবর্জ্য ও প্লাস্টিক দূষণকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীদূষণের প্রভাব বহুমাত্রিক। দূষিত পানি দিয়ে সেচ দেওয়ায় বিষ শাকসবজি ও ফসলের মাধ্যমে মানুষ ও গবাদি পশুর দেহে ঢুকছে। মাছের মাধ্যমে ঢুকছে মানবদেহে। এতে ক্যান্সার, কিডনি বিকলসহ নানা প্রাণঘাতী রোগ বাড়ছে। মাছসহ অন্যান্য জলজপ্রাণীর প্রজনন হ্রাস পাচ্ছে। মৃত্যু হচ্ছে। এরই মধ্যে শতাধিক প্রজাতির মাছ প্রায়-বিলুপ্ত। এ ছাড়া দূষিত পানির শেষ গন্তব্য হচ্ছে বঙ্গোপসাগর। গবেষণায় বঙ্গোপসাগরে আহরিত মাছের দেহে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি মিলেছে। ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির (আইইউবি) পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবদুল খালেক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নদীর পানিতে পিএইচ মান ৫ থেকে ৭.৫ স্বাভাবিক। এর চেয়ে বেড়ে বা কমে গেলে পানি ক্ষারীয় বা অ্যাসিডিক হয়ে যাবে। উপকারী ব্যাকটেরিয়া মারা যাবে। জলজপ্রাণীর জীবনধারণ সংকটে পড়বে। এ ছাড়া জলজপ্রাণীর স্বাভাবিক জীবন ধারণে প্রতি লিটার পানিতে অক্সিজেন (ডিও) ন্যূনতম ৫.৫ মিলিগ্রাম থাকতে হবে। বিওডি ২ মিলিগ্রাম ও সিওডি ১০ মিলিগ্রামের বেশি থাকা যাবে না। নদনদীতে মাত্রাতিরিক্ত জৈব ও রাসায়নিক দূষণের কারণে বাড়ছে বিওডি ও সিওডি। এগুলো যত বাড়ে, অক্সিজেন তত কমে। দূষণের কারণে এখন স্বাদুপানির মাছ কমে যাচ্ছে। এ ছাড়া নানাভাবে এসব বিষ আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি।

গত বছর নদনদী দূষণের ওপর আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় নদী কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনের তথ্য উল্লেখ করে বলেন, দেশে নদীদূষণের মোট আর্থিক বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ ২৮৩ কোটি ডলার (প্রায় ২৯ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা)। এ পরিস্থিতি নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়া হলে ক্ষতির পরিমাণ আগামী ২০ বছরে ৫ হাজার ১০০ কোটি ডলারে পৌঁছাবে। বর্তমানে নদনদীগুলো জৈব ও রাসায়নিক দূষণে মৃতপ্রায়। ২২ মার্চ তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নদীগুলোর বড় সমস্যা এখন দূষণ। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো দূষণ ঘটাচ্ছে। ইটিপি বসালেও খরচ বাঁচাতে চালাচ্ছে না। এটা দেখা পরিবেশ অধিদফতরের দায়িত্ব। দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্পগুলোকে তারা চাপ দিলে শিল্পদূষণ বন্ধ হতো। ঢাকার উত্তরের সব নদী-খাল থেকে শিল্পবর্জ্য এসে তুরাগ, বুড়িগঙ্গা, বালু নদের পানি বিষাক্ত করছে। ২০০৯ সালে নদীগুলোকে ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া ঘোষণা করা হয়। এ ঘোষণার পর পরিবেশ অধিদফতরের যে কাজ, তা তারা করেনি। বারবার বলেছি, চিঠি দিয়েছি। আমাদের বাজেটও নেই, জনবলও নেই। সবাই এগিয়ে না এলে দূষণ বন্ধ সম্ভব না।’

এদিকে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) বাংলাদেশের বিপন্ন প্রাণীর তালিকা করতে ২০০০ সালে জরিপ চালিয়ে ৫৪ প্রজাতির মাছ বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করে। ২০১৫ সালে সর্বশেষ জরিপে আরও ৬৪ প্রজাতির মাছ যুক্ত হয়। ওই বছর ২৫৩ প্রজাতির মাছের ওপর পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, বিলুপ্তপ্রায় মাছের বেশির ভাগই নদীর, মানে স্বাদুপানির। তবে আইইউসিএন ২০১৫ সালে মোট ৬৪ প্রজাতির মাছকে লাল তালিকাভুক্ত করে, যেগুলো প্রায়-বিলুপ্ত, মহাবিপন্ন বা বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রায়-বিলুপ্ত ৬৪ প্রজাতির মাছের মধ্যে ৩৯টি আমরা গবেষণা করে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি। বাকিগুলো আনার চেষ্টা চলছে। নদীর মাছ কমে যাওয়ার পেছনে দূষণের পাশাপাশি প্রজনন ক্ষেত্র সংকুচিত হওয়া ও প্রচুর আহরণও দায়ী।’ তিনি বলেন, ‘পানিতে অক্সিজেন কমে গেলে মাছ দম ফেলতে পারবে না এটাই স্বাভাবিক। নদীতে অতিমাত্রায় ভারী ধাতুর দূষণ হলে তা আমাদের খাদ্যচক্রেও ঢুকবে।’

সর্বশেষ খবর