চলতি বছরের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে গতকাল। সারা দেশের ৯টি সাধারণ এবং মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে মোট ২০ লাখ ৪১ হাজার ৪৫০ জন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করেছে ১৬ লাখ ৪১ হাজার ১৪০ জন। পাসের হার ৮০ দশমিক ৩৯ ভাগ। এর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৮ জন। গতকাল সকালে পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের ওয়েবসাইট (www.educationboardresults.gov.bd), সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটে ফল প্রকাশ করা হয়। এরপর বেলা ১১টায় রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে সংবাদ সম্মেলন করে ফলাফলের বিস্তারিত তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এ সময় উপস্থিত ছিলেন। এর আগে সকালে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর হাতে ফলাফলের অনুলিপি তুলে দেন শিক্ষামন্ত্রী ও উপমন্ত্রী। চলতি বছরে সব বিষয়ে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা নেওয়ায় পাস ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তি উভয়ই কমেছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত বছর এসএসসি ও সমমানে ১৯ লাখ ৯৪ হাজার ১৩৭ জন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করেছিল ১৭ লাখ ৪৩ লাখ ৬১৯ জন। পাসের হার ছিল ৮৭ দশমিক ৪৪ ভাগ। গত বছরের চেয়ে এবার ১ লাখ ২ হাজার ৪৭৯ জন কম পাস করেছে। পাসের হার কমেছে ৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। আর জিপিএ-৫ কমেছে ৮৬ হাজার ২৪টি।
তথ্যমতে, গত বছর সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষার বিষয়, নম্বর ও সময় কমিয়ে নেওয়া হয় এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। ৩ ঘণ্টার স্থলে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল ২ ঘণ্টায়। ১২টি বিষয়ের স্থলে পরীক্ষা নেওয়া হয় ৯টি বিষয়ে। এতে উল্লম্ফন হয়েছিল ফলাফলে। কিন্তু চলতি বছরে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা হলেও সব বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়। পরীক্ষাও হয়েছে পুরো ৩ ঘণ্টায়। বেশি বিষয়ে, বেশি নম্বরে পরীক্ষা দিয়ে তুলনামূলক কম ফল করেছে ছাত্রছাত্রীরা। এদিকে পাসের হারে মানবিকের শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক খারাপ করেছে, যা প্রভাব ফেলেছে মোট ফলাফলে। দেখা গেছে চলতি বছরে বিজ্ঞানে পাস করেছে ৯৪ দশমিক ৭২ ভাগ, ব্যবসায় শিক্ষায় ৮৫ দশমিক ৩২ শতাংশ ও মানবিকে পাস করেছে ৭৪ দশমিক ৭২ ভাগ। এ ছাড়া বরাবরের মতো সিলেট শিক্ষা বোর্ড পাসের হারে এবারও পিছিয়ে রয়েছে, যা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার জানান, ২০২২ সালে মাত্র ৯টি বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এবার সব বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়। এ ছাড়া এবার বিষয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সময়ও বৃদ্ধি করা হয়েছে। গত বছর ২ ঘণ্টায় পরীক্ষা নেওয়া হলেও এবার নেওয়া হয় ৩ ঘণ্টায়। এসব কারণে ফলাফল ও জিপিএ-৫ গত বছরের চেয়ে কম। করোনার কারণে আগের বছরগুলোয় কম নম্বর ও কম বিষয়ে পরীক্ষা হয়েছিল। দেখা গেছে, ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে ১৬ লাখ ৩৩ হাজার ৯১৯ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করেছে ১৩ লাখ ২২ হাজার ৪৪৬ জন। পাসের হার ৮০ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৫৯ হাজার ২২০ জন। দাখিলে ২ লাখ ৮৫ হাজার ৮৭ জন পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছে ২ লাখ ১২ হাজার ৯৬৪ জন। পাসের হার ৭৪ দশমিক ৭ শতাংশ। এ বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬ হাজার ২১৩ জন। কারিগরি বোর্ডে ভোকেশনালে ১ লাখ ২২ হাজার ৪৪৪ জন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করেছে ১ লাখ ৫ হাজার ৭৩০ জন, পাসের হার ৮৬ দশমিক ৩৫ ভাগ, জিপিএ-৫ পেয়েছে ১৮ হাজার ১৪৫ জন।
গতকাল সরকারি ছুটির দিনে এসএসসির ফল প্রকাশ করা হয়। ছুটির দিন হলেও স্কুলে স্কুলে লক্ষ করা গেছে ভালো ফল করা শিক্ষার্থীদের বাঁধভাঙা উল্লাস। নেচে-গেয়ে, ঢাকঢোল পিটিয়ে উৎসব করে কৃতী শিক্ষার্থীরা। রাজধানীর সামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এবার ১ হাজার ৫৬২ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে শতভাগ পাস করেছে, জিপিএ-৫ অর্জন করেছে ১ হাজার ১২২ জন। এমন ফলে উল্লাসে-আনন্দে মেতে ওঠে শিক্ষার্থীরা। অধ্যক্ষ মো. মাহবুবুর রহমান মোল্লা বলেন, এ অর্জন শিক্ষার্থী-অভিভাবক-শিক্ষকদের সমন্বিত প্রচেষ্টার ফল। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এবার ২ হাজার ৯৮ জন পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছে ২ হাজার ৮৬ জন। পাসের হার ৯৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ হাজার ৬৫৯ জন। মাইলস্টোন কলেজ থেকে মোট ১ হাজার ৫৫৬ জন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করেছে ১ হাজার ৫৫২ জন। পাসের হার ৯৯ দশমিক ৭৪ ভাগ, জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ হাজার ১১৮ জন শিক্ষার্থী।
পাস, জিপিএ-৫ সব ক্ষেত্রে এগিয়ে মেয়েরা : গতবারের মতো এবারও এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাস ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তি সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে আছে মেয়েরা। এবার ছেলেদের পাসের হার ৭৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ আর মেয়েদের ৮১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এ ছাড়া ৮৪ হাজার ৯৬৪ জন ছাত্র ও ৯৮ হাজার ৬১৪ জন ছাত্রী জিপিএ-৫ পেয়েছে। সে হিসেবে ছাত্রের তুলনায় ১৩ হাজার ৬৫০ বেশি ছাত্রী জিপিএ-৫ পেয়েছে।
পাসের হারে এগিয়ে বরিশাল বোর্ড, জিপিএ-৫-এ ঢাকা : এ বছরের এসএসসি পরীক্ষায় পাসের হারে শীর্ষে রয়েছে বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের শিক্ষার্থীরা। এ বোর্ডে এবার সবচেয়ে বেশি ৯০ দশমিক ১৮ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। আর সবচেয়ে কম পাস করেছে সিলেট বোর্ডে, ৭৬ দশমিক ০৬ শতাংশ। প্রতিবারের মতো এবারও জিপিএ-৫-এ সবার ওপরে রয়েছে ঢাকা বোর্ডের শিক্ষার্থীরা, এ শিক্ষা বোর্ডের ৪৬ হাজার ৩০৩ জন শিক্ষার্থী পূর্ণ জিপিএ পেয়েছে। তবে শতাংশ হিসেবে কারিগরি বোর্ডের শিক্ষার্থীরা জিপিএ-৫ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে। এবার এ বোর্ডে ১৪ দশমিক ৮২ শতাংশ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে।
কমেছে শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠান ও শতভাগ ফেল : মাধ্যমিক পরীক্ষায় এ বছর ৪৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থী পাস করতে পারেনি; গত বছর কোনো শিক্ষার্থী পাস করেনি এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৫০। এবার শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২ হাজার ৩৫৪। আর ২ হাজার ৯৭৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গতবার শতভাগ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছিল। সে হিসেবে শতভাগ পাসের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবার ৬২১টি কমেছে, সব পরীক্ষার্থী ফেল করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমেছে দুটি।
বিদেশ কেন্দ্রে পাস ৮৫ দশমিক ৩৩ : এবার এসএসসি ও সমমানে বিদেশের আটটি কেন্দ্র থেকে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ৩৭৫ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে পাস করেছে ৩২০ জন, পাসের হার ৮৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন শুরু আজ : আজ শনিবার এসএসসির ফল পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন শুরু হয়েছে, প্রতি পত্রের জন্য ১২৫ টাকা দিয়ে আবেদন চলবে ৪ আগস্ট পর্যন্ত। এজন্য টেলিটক প্রিপেইড ফোন থেকে জঝঈ স্পেস বোর্ডের নামের প্রথম তিন অক্ষর স্পেস রোল নম্বর স্পেস বিষয় কোড লিখে ১৬২২২ নম্বরে এসএমএস পাঠাতে হবে। ফল প্রকাশের সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য প্রদানকালে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, এবার সব বিষয়ে পূর্ণ সময় এবং পূর্ণ নম্বরে পরীক্ষা হওয়ায় পাসের হার ও জিপিএ-৫ কিছুটা কমেছে। করোনার আগের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে পাসের হার ও জিপিএ-৫ এমনই ছিল। করোনা মহামারির কারণে গত কয়েক বছরে কম বিষয়ে, কম নম্বরে পরীক্ষা হয়েছিল; ফলে শিক্ষার্থীরা এক ধরনের সুবিধাও পেয়েছিল। যেটা চলতি বছর ছিল না।