বাড়িতে একটা কঙ্কাল পাওয়া গেছে! ফোনে এ কথা জানান পানির লাইনের মিস্ত্রি। ওইদিন বিকালে এ কথা পিলে চমকে ওঠার মতোই ছিল রাজধানীর মিরপুর শ্যাওড়া পাড়ার বাসিন্দা হানিফ সরকারের কাছে। এমন কথা শুনবেন তিনি তা কোনোদিন কল্পনাও করেননি। অথচ দিনটা তার শুরু হয়েছিল খুব সাদামাটাভাবেই।
২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর হানিফ নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে পানির লাইন মেরামতের জন্য যাওয়া মিস্ত্রি ফোনে তাকে বলেন, ‘স্যার একটু নিচতলায় আসেন। ফোনে বলা যাবে না।’
নিচে যাওয়ার পর তাকে মিস্ত্রি বলল- ‘স্যার বাথরুমের ফলস ছাদের ওপর মনে হয় একটা লাশ পাইছি।’ এ কথা শুনে হানিফ বলেন- ‘ব্যাটা কী কস, পাগলের কথা।’ পলিথিন, সিমেন্ট আর কংক্রিট দিয়ে মোড়ানো অবস্থায় পাওয়া যায় মানুষের কঙ্কাল। কঙ্কালটি টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। খবর পেয়ে পুলিশ কঙ্কাল উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায়। এ ছাড়া ডিএনএ পরীক্ষার জন্য আলামত সিআইডিতেও পাঠায় মিরপুর থানা পুলিশ। এ ঘটনার প্রায় তিন বছর পেরিয়ে গেলেও তার কোনো রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন- যে কঙ্কালটি পাওয়া গেছে সেটি আসলে কার? তিনি নারী, নাকি পুরুষ? কে লাশটি এভাবে গুম করল?- এমন সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গত তিন বছর ধরে টানা কাজ করছে সিআইডি। তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে গঠন করা একটি মেডিকেল বোর্ড ওই কঙ্কালটি পুরুষের বলে মত দিয়েছে। একই সঙ্গে যার কঙ্কাল ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে কঙ্কাল উদ্ধারের প্রায় দুই বছর আগে বলেও জানানো হয়েছে। এই রহস্য বের করতে ওই বাড়িতে কোন কোন রাজমিস্ত্রি কাজ করেছেন, তাদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। পুলিশের তথ্য ভান্ডার সিডিএমএসে নিখোঁজ ব্যক্তির তথ্য চাওয়া হয়েছে এবং কঙ্কালের বিষয়টি জানানো হয়েছে। সারা দেশের প্রতিটি থানায় তথ্য চেয়ে তারবার্তা পাঠানো হয়েছে। আর মিরপুরে যেখানে শ্রমিক কেনাবেচা হয় সেখানেও নিখোঁজ শ্রমিক সম্পর্কে তথ্য জানার চেষ্টা করা হয়েছে। ওই সময় কঙ্কালের সঙ্গে একটি গামছার টুকরা পাওয়া গিয়েছিল, সেটির সূত্র ধরেও বিভিন্ন টেক্সটাইল মিলে এবং কতদিন আগের গামছা তা জানার চেষ্টা করা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক জেহাদ হোসেন এ প্রতিবেদককে বলেন, আমরা হাল ছাড়িনি। তদন্ত অব্যাহত আছে। এই রহস্য উন্মোচনে আমরা সফল হব।
সিআইডি সূত্র বলছে, ওই কঙ্কালের রহস্য উদঘাটনে একজনকে ২০২১ সালের ১২ জানুয়ারি গ্রেফতার করা হয়। ওই ব্যক্তির নাম মিজানুর রহমান। তিনি ওই বাড়িতে সর্বশেষ রাজমিস্ত্রির কাজ করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে অন্য একটি থানায় ডাকাতির মামলা আছে। তবে তার কাছ থেকে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বর্তমানে মিজান জামিনে আছেন বলে জানা গেছে। জানা যায়, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে হানিফের বাড়ির নিচতলায় পানির লাইন বন্ধ হয়ে যায়। ওইদিন মিস্ত্রি সেটি মেরামত করতে যায়। কোনো সমস্যা না পেয়ে সে বাথরুমের ওপরে ফলস ছাদে ওঠে। সেখানে পাইপ পরীক্ষা করতে গিয়ে দেয়াল ভাঙে। এরপর দেখে প্লাস্টিকে মোড়ানো কিছু একটা। হানিফ সরকারের মিরপুরের পশ্চিম শেওড়া পাড়ার ৩৮৯ নম্বর পঞ্চমতলা বাড়ির নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৯০ সালে। এর তিন বছর পর তিনিই নিচতলার প্রথম বাসিন্দা। বাড়ির ওপরের অংশ তৈরি হয়ে গেলে তিনি ওপরে উঠে যান। এরপর থেকে সেখানে মোট চারজন ভাড়াটিয়া উঠেছে। একজন ভাড়াটিয়া দীর্ঘদিন ছিলেন। তার পরিবার চলে যাওয়ার পর একবার ফ্ল্যাটটিতে সংস্কার কাজও করা হয়েছে। কঙ্কালটি উদ্ধারের পর পুলিশ বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করে। মামলার পরই মিরপুর থানার এসআই শফিকুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, হত্যার পর খুনি শুধু পলিথিন দিয়ে লাশ মোড়ায়নি, চা পাতাও দিয়ে রেখেছিল। ফলে লাশের গন্ধ বের হয়নি।