সরকারি গবেষণা সংস্থা বিআইডিএস বলছে, দেশের মানুষের স্বাস্থ্য চিকিৎসায় যে ব্যয় হয় সেটা একজন মানুষের মোট আয়ের প্রায় ৭৩ শতাংশ। এটা খুবই উদ্বেগজনক। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে-স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বরাদ্দ অনেক কম এবং যতটুকু বরাদ্দ হয় তাও সঠিকভাবে কার্যকর হয় না। এজন্য প্রতি বছর একজন মানুষ যা আয় করেন তার ৭৩ শতাংশ চলে যায় চিকিৎসা খরচে। শুধু তাই নয়, সংস্থাটি বলছে, চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতি বছর ৬১ লাখ ৩০ হাজার মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যায়। যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৩ দশমিক ৭ শতাংশ।
গতকাল বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) আয়োজনে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিআইডিএস সম্মেলন কক্ষে এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন। সেমিনারে গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন সংস্থাটির রিসার্স ফেলো ড. আবদুর রাজ্জাক সরকার। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন।
গবেষণাপত্রের তথ্যানুসারে, চিকিৎসা খাতে মানুষের সবচেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে ওষুধ কিনতে, যার পরিমাণ ৫৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে ডায়াগনস্টিকের জন্য ২৭ দশমিক ৫২ শতাংশ, কনসালটেশনের জন্য ১০ দশমিক ৩১ এবং পরিবহনের জন্য খরচ হয় ৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ অর্থ। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতি বছর ৬১ লাখ ৩০ হাজার মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যায়, যা মোট জনসংখ্যার ৩ দশমিক ৭ শতাংশ।
প্রধান অতিথি হিসেবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, আমি স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন করব। কেননা, এটা আমার জন্য চ্যালেঞ্জ। এ আইনের মাধ্যমে রোগী ও চিকিৎসক সব পক্ষকে সুরক্ষা দেওয়া আমার দায়িত্ব। সেই সঙ্গে হেলথ ইন্স্যুরেন্সের কাজ চলছে। স্বাস্থ্য খাতের সমস্যা অনেক। সব রাতারাতি শেষ হবে না। তবে আমি চেষ্টা করছি। এক্ষেত্রে সবার সহায়তা লাগবে। মানুষের পকেট থেকে যাতে অধিক অর্থ স্বাস্থ্য খাতে চলে না যায় সেজন্য আমি হেলথ ইন্স্যুরেন্স করব। এজন্য ভারতের মোদি কেয়ারের মতো কিছু করা যায় কি না সেটি ভাবা হচ্ছে। তবে একটু সময় লাগবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি মন্ত্রী হব তা কখনো ভাবিনি। কিন্তু যখন দায়িত্ব পেয়েছি তখন স্বাস্থ্য খাতের অনেক বিষয় নিয়েই জানতে হচ্ছে। তবে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে না পারলে ঢাকায় বসে যতই লেকচার দিই লাভ হবে না। এজন্য গ্রামের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে আগে কাজ করছি। অবৈধ ফার্মেসি দমনে ড্রাগের মহাপরিচালককে শক্ত ভূমিকা নিতে হবে।
এদিকে গবেষণাপত্রে ড. আবদুর রাজ্জাক সরকার বলেন, ‘১৯৯৭ সালে চিকিৎসার পেছনে মানুষের পকেট থেকে চলে যেত ৫৫ দশমিক ৯ শতাংশ অর্থ। সেটি বেড়ে ২০২০ সালে হয়েছে ৬৮ শতাংশ, সর্বশেষ ২০২১ সালের হিসাবে তা আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩ শতাংশে। এটা খুবই উদ্বেগজনক। এ কারণে মানুষের আর্থিক সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। বহু মানুষ নিঃস্বও হয়ে যায় চিকিৎসার খরচ মেটাতে।
এতে আরও বলা হয়, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেছেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যয় সবচেয়ে বেশি আফগানিস্তানে ৭৭ দশমিক ২০ শতাংশ। এরপরই রয়েছে বাংলাদেশ। যেখানে ব্যয় হয় ৭৩ শতাংশ। এ ছাড়া পাকিস্তানে ৫৭ দশমিক ৫০ শতাংশ, নেপালে ৫১ দশমিক ৩০, ভারতে ৪৯ দশমিক ৮০, শ্রীলঙ্কায় ৪৩ দশমিক ৬০, ভুটানে ১৮ দশমিক ৮০ শতাংশ এবং সবচেয়ে কম খরচ হয় মালদ্বীপে ১৪ দশমিক ৩০ শতাংশ অর্থ। এতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘বাংলাদেশে ব্যক্তির পকেট থেকে যে অর্থ ব্যয় হয় এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চলে যায় ক্যান্সারের পেছনে। এতে ব্যয় হয় গড়ে ২ লাখ ২৩ হাজার ৯৩৮ টাকা। এ ছাড়া কভিডের সময় খরচ হয়েছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৭০৯ টাকা। হার্টের অসুখের জন্য ৯৯ হাজার ৭১৫ টাকা, লিভার অসুখের জন্য ৭৮ হাজার ৯৪৩ টাকা এবং জন্ডিসে খরচ হয় ৭৬ হাজার ৪৫৩ টাকা। সবচেয়ে কম খরচ হয় জ্বরের কারণে। বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন বলেন, ‘গ্রামে কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে সরকার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের চেষ্টা করছে। কিন্তু শহরেও এরকম কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিটি ওয়ার্ডে থাকা দরকার। যাতে মানুষ প্রাথমিক চিকিৎসা পেতে পারে কম খরচে। চিকিৎসা খাতে বরাদ্দ কমপক্ষে জিডিপির ৫ শতাংশ হওয়া উচিত।