‘স্বাধীনতা তুমি বাগানের ঘর, কোকিলের গান, বয়েসি বটের ঝিলিমিলি পাতা, যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।’ জেন-জি বা জেনারেশন জেড-এর অর্জিত স্বাধীনতা ২.০ এর বদৌলতে সূচনা হয়েছে বাংলাদেশ ২.০ যুগের। এক পৃথিবী লিখবে বলে একটি পাতাও শেষ না করা এই প্রজন্ম ৩৬ জুলাইয়ের পর থেকে প্রতিদিন নতুন করে লিখছে বাংলাদেশের ইতিহাস। তাদের রংতুলির রঙিন আঁচড়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে নগরীর প্রতিটি জরাজীর্ণ দেয়াল। একেকটি দেয়াল যেন হয়ে উঠেছে একেকটি কবিতার খাতা। প্রেম, দ্রোহ, জুলাই আগস্টের উত্তাপ ছড়ানো ছোট বড় গল্প আর নতুন বাংলাদেশ গড়ার ইশতেহার উঠে এসেছে রংতুলির আঁচড়ে আঁকা এসব কবিতায়।
এসেছে ফাগুন হয়েছি দ্বিগুণ : জহির রায়হানের আরেক ফাল্গুন উপন্যাসের ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো’ কথাটা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে উদ্দীপ্ত করেছে। স্বপ্ন দেখিয়েছে বিপ্লবের। জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। তবে বহুল আলোচিত জেন-জি এবার আর কোনো ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করেনি। আন্দোলনের শুরু থেকেই তারা লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ারলি দেয়ালে দেয়ালে লিখতে শুরু করে, এসেছে ফাগুন হয়েছি দ্বিগুণ। মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বরের মেট্রোরেলের একটি পিলারে জেন-জিরা লিখেছে, এই যে দেখো চোখের আগুন এই ফাগুনে হয়েছি দ্বিগুণ।
আবু সাঈদের বিশ্বাসে ভরা বুক : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল রংপুরের আবু সাঈদের শহীদ হওয়ার ঘটনা। বন্দুকের সামনে কেবলমাত্র লাঠি হাতে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন আবু সাঈদ। একের পর এক বুলেট বিদ্ধ হয়েও সরে যাননি রণক্ষেত্র থেকে। নগরীর দেয়ালে দেয়ালে আবু সাঈদের সেই বিশ্বাসে ভরা বুকের চিত্র এঁকেছে জেন-জিরা। বাংলাদেশের মানচিত্র আগলে নগরের দেয়ালে দেয়ালে অভ্যুত্থানের প্রতীক হয়ে স্বমহিমায় এখনো জেগে আছেন আবু সাঈদ।
পানি লাগবে পানি : ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানের আরেক শহীদ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। এক মুগ্ধর অন্তর্ধানে জন্ম নিয়েছে হাজার হাজার মুগ্ধ। পানির বোতল হাতে সারা বাংলাদেশের দেয়ালে দেয়ালে এখনো চিৎকার করে মুগ্ধ বলছেন, পানি লাগবে কারও, পানি?
শহীদরা আমাদের শোক নয়, তারা আমাদের শক্তি : মিরপুর-১১ নম্বরে মেট্রোরেলের এক পিলার। আবু সাঈদ, মুগ্ধসহ আরও কয়েকজনের ছবি আঁকা। ওপরে লাল রঙে লেখা- শহীদরা আমাদের শোক নয়, তারা আমাদের শক্তি। এই দেয়ালচিত্র মনে করিয়ে দেয়, হাসিনা শাহীর সেই প্রহসনের রাষ্ট্রীয় শোককে। যে শোককে প্রত্যাখ্যান করে ছাত্র-জনতা কর্মসূচি দিয়েছিল, শোক নয় শক্তির। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের নীল সাদা দেয়াল সেদিন হয়ে উঠেছিল রক্তবর্ণের। মেট্রোরেলের পিলারে যেন সেই কথাই লিখেছে জেন-জিরা। ‘মানি না তোমার ওই ভণ্ড চেতনা, আগুন নিয়ে আর খেলো না।
বুলেট কিংবা ফুল, এই ২৪-ই ৭১ : পল্লবীতে মেট্রোরেলের পিলারে এমনটাই লিখে রেখেছে জেন-জিরা। শহরের বিভিন্ন প্রান্তের দেয়ালচিত্রে অহরহ দেখা মিলছে এই লেখার। উত্তরার এক দেয়ালে তারা লিখেছে ‘২৪ মানে মাথা নত না করা’। আরও লিখেছে ‘৫২ দেখিনি, ৭১ দেখিনি, ২৪ দেখেছি।’ মিরপুরের এক পিলারে লিখেছে ‘আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেইনি’, ‘স্বাধীনতা এনেছি সংস্কারও আনবো’। মিরপুরের কাজীপাড়ার এক পিলারে ড. ইউনূসের ছবি এঁকে তাকে উদ্ধৃত করে লিখেছে ‘এই স্বাধীনতার সুফল পৌঁছে দিতে হবে বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে’।
আমার ভাই কবরে খুনিরা কেন বাহিরে? : জুলাই-আগস্ট গণহত্যার এক মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো নিশ্চিত করা যায়নি এর প্রকৃত ন্যায়বিচার। শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনকালে সংঘটিত সব হত্যাযজ্ঞের বিচারের কথাও লেখা হয়েছে দেয়ালে দেয়ালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের সামনের দেয়ালে লেখা, ‘আমার ভাই কবরে, খুনিরা কেন বাহিরে?’। এর পাশের দেয়ালেই আঁকা হয়েছে পিলখানা হত্যাযজ্ঞের এক মর্মস্পর্শী ছবি। এক সেনা সদস্য লাশের খাটিয়া কাঁধে অঝোরে কাঁদছেন। নিচে লেখা ‘পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই’।
ধর্ম যার যার দেশটা সবার : মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বর। জেন-জিরা মেট্রোরেলের পিলারে রংতুলিতে এই এলাকার নাম লিখেছে, স্বাধীনতা চত্বর। রাস্তার মাঝখানের পুলিশ বক্সের ওপরে উদ্ধৃত করেছে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর একটি কথা। ‘শোনো ধর্ম আর দেশ মিলাইতে যায়ো না, পরে ফুলের নাম কী দিবা? ফাতেমা চূড়া?’ বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক স্বপ্ন দেখে এক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এক দেয়ালে জেন-জিরা এঁকেছে, ‘আওয়ার নিউ সেকুলার বাংলাদেশ’। মিরপুরেরই আরেক দেয়ালে লিখেছে, ‘এক জাতির দেশ নয়, বহু জাতির বাংলাদেশ’, ‘বাংলার মুসলিম বাংলার হিন্দু বাংলার খ্রিস্টান বাংলার বৌদ্ধ সবাই মিলে বাংলাদেশ’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের সামনের দেয়ালে লালনের ছবি এঁকে প্রশ্ন করেছে, কেউ মালা কেউ তসবি গলে তাইতে কি জাত ভিন্ন বলে?
পাহাড় থেকে সমতল দেশটা আমাদের সবার : রাজধানীর দেয়ালচিত্রের আরেকটি বড় উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নিয়ে। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির আশপাশের এলাকা ঘুরে বেশ কিছু দেয়ালচিত্র চোখে পড়ে। পাহাড় থেকে সমতল মুক্তি পাক সকলে। আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই।
হ্যাশট্যাগ ইন্ডিয়া আউট : রাজধানীর উত্তরা, মিরপুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাগুলোর দেয়ালে লেখা হয়েছে- হ্যাশট্যাগ ইন্ডিয়া আউট, মোংলা বন্দর বুঝে নাও, তিস্তার পানি বুঝে নাও, ভারত খেদাও, বয়কট ইন্ডিয়া, পেতে চাইলে মুক্তি ছাড়ো ভারত ভক্তি, ভারত বিদ্বেষ দেশ প্রেমের সমমান, দিল্লি না ঢাকা? ঢাকা ঢাকা। ভারতীয় আগ্রাসন ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও। ইত্যাদি।