অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আবুল কাশেমের যেন উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। আরমানিটোলা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের ১২০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে এসে প্রায় ৪৬ বছর পর অনেক বন্ধুর সঙ্গে দেখা তাঁর। স্কুল জীবনের বন্ধুদের কাছে পেয়ে স্মৃতি রোমন্থন করলেন। বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা, হাসিকান্না সব স্মৃতি যেন মনে পড়ে যায় তাঁর। তিনি জানান, ১৯৭৯ সালের এসএসসির ব্যাচ ছিলেন। ব্যাচটিতে প্রায় ২০০ ছাত্র থাকলেও পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে ২০ জনের মতো বন্ধুর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে।
‘জুড়ে থাকি আজীবন, ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে’ স্লোগানে পুরান ঢাকায় আরমানিটোলা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের ১২০ বছর পূর্তি উদ্যাপন ও পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে গতকাল। দুই দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠান শেষ হবে আজ। বর্ণাঢ্য এ আয়োজনের মিডিয়া পার্টনার বাংলাদেশ প্রতিদিন। স্কুলের প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের মিলনমেলায় গতকাল নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়েছে দৃষ্টিনন্দন লাল ভবনের স্কুল আরমানিটোলা। পুনর্মিলনী উপলক্ষে স্কুলপ্রাঙ্গণ সাজানো হয়েছে লাল নীল আর হরেকরকমের ফেস্টুন দিয়ে। বিভিন্ন বুথে চলছে পিঠাপুলিসহ নানা আয়োজন। অনেক অ্যালামনাই এসেছিলেন পরিবার-পরিজন নিয়েও। স্ত্রী-সন্তানদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন স্কুলের সঙ্গে। সব মিলে পূর্তি উদ্যাপন অনুষ্ঠানে নবীন-প্রবীণ মিলেছিলেন এক অপরূপ মিলনমেলায়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত আরমানিটোলা হাইস্কুল তৈরি করেছে লক্ষাধিক শিক্ষাবিদ, আমলা, প্রকৌশলী, সামরিক অফিসার, ক্রীড়াব্যক্তিত্ব, চিকিৎসক, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী প্রভৃতি। এঁদের মধ্যে শুধু দেশবরেণ্য ব্যক্তি নয়, বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিবর্গও রয়েছেন। প্রখ্যাত ক্রীড়াবিদ আবদুস সাদেক, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান প্রথিতযশা শিল্পপতি আহমেদ আকবর সোবহানের মতো সফল মানুষ এ স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন। পুনর্মিলনীতে ২ সহস্রাধিক আরমানিটোলিয়ান যোগ দিয়েছেন।
পূর্তি অনুষ্ঠান উদ্যাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান বলেন, ‘বর্তমান শিক্ষার্থী আর অ্যালামনাইদের মধ্যে মেলবন্ধন তৈরি করবে আমাদের এ অনুষ্ঠান। স্কুলের ইতিহাস-ঐতিহ্য নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরছি আমরা। দেশবরেণ্য ও বিশ্ববরেণ্য অনেক ব্যক্তি আগে এ স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন। এ ঐতিহ্য ধরে রাখতে চাই আমরা।’
স্কুলপ্রাঙ্গণে প্রাক্তন শিক্ষার্থী, বরেণ্য ব্যক্তিদের নিয়ে সাজানো হয়েছে ‘ওয়াল অব গ্লোরি’। সেখানে শোভা পাচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য শিক্ষাবিদ আবদুল মমিন চৌধুরী, কৃতী হকি খেলোয়াড় আবদুস সাদেক, বিশ্বভারতীর উপাচার্য অধ্যাপক অম্লান দত্ত, ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্র, খ্যাতনামা সাহিত্যিক সৈয়দ আলী আহসান, প্রখ্যাত স্থপতি ফজলুর রহমান খান, সাবেক সচিব মনযূর উল করিম, ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব কুমার মুখোপাধ্যায়, সব্যসাচী ক্রীড়াবিদ প্রতাপ শংকর হাজরাসহ অন্যদের নাম। গতকাল প্রথম দিনের অনুষ্ঠান শুরু হয় সন্ধ্যার পর। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন ১৯৬৩ ব্যাচের ছাত্র আবদুস সালাম। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে হাতেগোনা কয়েকটি সরকারি স্কুল ছিল। এসব স্কুলের মধ্যে আরমানিটোলা উচ্চবিদ্যালয় ছিল সবার সেরা। বর্তমানে এমন কোনো পেশা নেই যেখানে এ স্কুলের শিক্ষার্থী নেই।’
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নুরুন নাহার। বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনেকে শুধু দেশবরেণ্য নন, অনেকে বিশ্ববরেণ্য হয়েছেন। এ স্কুলের অ্যালামনাইরা বর্তমান শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে রইবেন।’
প্রাক্তন শিক্ষক মহসিন হোসেন, আবদুল করিম পাটোয়ারী, মোহাম্মদ আলী, সাইফুদ্দিন ইয়াহইয়া, রোকেয়া বেগমসহ অন্য শিক্ষকদের ক্রেস্ট ও সম্মাননা স্মারক তুলে দেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নুরুন নাহার, উদ্যাপন কমিটির সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমানসহ অন্যরা। এরপর রাতে আয়োজিত হয় বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ১২০ বছর পূর্তি উদ্যাপনের প্রথম দিনে নাচ-গান আর আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠেন আরমানিটোলা উচ্চবিদ্যালয়ের বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। প্রসঙ্গত, অবিভক্ত বাংলায় ঢাকা ও আশপাশ এলাকায় শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে ১৯০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় যে বিদ্যালয়, তা দ্যুতি ছড়িয়ে যাচ্ছে আজও। আর্মেনিয়ানদের স্মৃতিবিজড়িত এ স্কুলটি প্রায় আড়াই একর জমির ওপর তৎকালীন ব্রিটিশ স্থাপত্যশিল্পের আদলে নির্মাণ করা হয়।
স্কুলের প্রধান ফটক পেরিয়ে সুবিশাল ময়দানের পরই দৃষ্টিনন্দন লাল ইটের গাঁথুনিতে তৈরি স্কুল ভবন কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সগৌরবে। ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়টির প্রাচীন কাঠের সিঁড়ি, গ্যালারি, লাইব্রেরি ও ছায়াদায়ী দেবদারু গাছ আজও বিদ্যমান।