দেশের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ন্যায়বিচার নিশ্চিতে সরকারিভাবে আইনি সহায়তা (লিগ্যাল এইড) দিতে গড়ে তোলা হয় জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা (এনএলএএসও)। বিচার বিভাগের প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব ছাড়া চলছে এই সংস্থা। বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা লিগ্যাল এইড অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও বাস্তবে জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থা চলছে আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে। আর এনএলএএসও পরিচালনা বোর্ডেও প্রভাবশালী ভূমিকায় রয়েছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আমলারা। সুপ্রিম কোর্ট বা প্রধান বিচারপতির সংশ্লিষ্টতা নেই এতে। এসব বিষয়ে বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে রয়েছে নানা আলোচনা ও সমালোচনা।
এদিকে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে লিগ্যাল এইড কমিটি থাকলেও এখানে প্রধান বিচারপতির কার্যকর নিয়ন্ত্রণ নেই। প্রধান বিচারপতি শুধু সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান মনোনয়ন দেন। তবে এই কমিটি কার কাছে দায়বদ্ধ সে বিষয়েও সুস্পষ্ট প্রস্তাবনা নেই আইনে।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ নিজেও লিগ্যাল এইডে সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণ না থাকা নিয়ে নিজের বক্তব্য জানিয়েছেন। গত বছর ২১ সেপ্টেম্বর সারা দেশের সব বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের উদ্দেশে অভিভাষণে লিগ্যাল এইড নিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, জেলা আদালতের মতো সুপ্রিম কোর্টেও লিগ্যাল এইড অফিস রয়েছে। জেলা আদালতের ওপর হাই কোর্ট বিভাগের তত্ত্বাবধান এখতিয়ার থাকলেও লিগ্যাল এইড অফিসগুলোর ওপর সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিসের বা হাই কোর্টের কার্যকর কোনো তত্ত্বাবধান নেই। লিগ্যাল এইড অফিসগুলোকে সুপ্রিম কোর্টের আওতাধীন করে প্রয়োজনীয় আইনি সংশোধনী আনা হলে লিগ্যাল এইড কার্যক্রম আরও গতিশীলতা পাবে বলে আমার বিশ্বাস। আইনজ্ঞদের মতে, লিগ্যাল এইডে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা কাজ করলেও এই বিভাগের নিয়ন্ত্রণ না থাকাটা সঠিক হয়নি। পার্শ¦বর্তী অন্যান্য দেশেও প্রধান বিচারপতির অধীনেই রয়েছে লিগ্যাল এইড। কাক্সিক্ষত সেবা নিশ্চিতে আইন সংশোধন করেও লিগ্যাল এইডকে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে আনা উচিত বলে মনে করেন তারা।
জানা গেছে, আইন অনুযায়ী লিগ্যাল এইডের জাতীয় পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে থাকেন আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। একই সঙ্গে বোর্ডে জাতীয় সংসদের স্পিকারের মনোনীত দুজন সংসদ সদস্য (একজন সরকার দলীয় এবং অন্যজন বিরোধী দলীয়), অ্যাটর্নি জেনারেল, আইন সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, সমাজ কল্যাণ সচিব, আইজিপি, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল, কারা মহাপরিদর্শক, বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি, জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান থাকেন। লিগ্যাল এইডের বিষয়ে পার্শ¦বর্তী দেশগুলোর চিত্র ভিন্ন। ভারতের আইনগত সহায়তা কার্যক্রমে তিন স্তরের একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামো রয়েছে। এর কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ প্রধান বিচারপতির অভিভাবকত্বে কাজ করে। প্রধান বিচারপতি এখানে প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং সুপ্রিম কোর্টের একজন বর্তমান কিংবা অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এখানে নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেন। এখানে নির্বাহী চেয়ারম্যানের নিয়োগ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক হলেও এ নিয়োগের বেলায় আইন মোতাবেক প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গরিব মানুষের জন্য আইনি সহায়তা যেন প্রকৃত অর্থেই হয় ন্যায্য ও নিরপেক্ষ, সেজন্য বিচার বিভাগীয় নেতৃত্ব অত্যাবশ্যক। সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় নিয়ে এখন কথা হচ্ছে। আমি আশা করব, এই সচিবালয় হলে আইন সংশোধন করে লিগ্যাল এইডের নিয়ন্ত্রণও সুপ্রিম কোর্টের অধীনে আনা হবে।
জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস আজ : এদিকে ‘দ্বন্দ্বে কোনো আনন্দ নাই, আপস করো ভাই, লিগ্যাল এইড আছে পাশে, কোনো চিন্তা নাই’ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে আজ ‘জাতীয় আইনগত সতায়তা দিবস-২০২৫’ পালন করা হচ্ছে সারা দেশে। দিবসটি কেন্দ্র করে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ র্যালি ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির উদ্যোগেও সারা দেশে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।