আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নিজেদের দেওয়া মৌলিক সংস্কার দ্রুত বাস্তবায়ন চায় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচনা করছে দলটি। পাশাপাশি এসব মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নে প্রয়োজনে সরকারের ওপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে চায় এনসিপি।
এনসিপির দেওয়া মৌলিক সংস্কারের রূপরেখায় পাঁচটি বিষয়কে মূল উপাদান হিসেবে বলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-শাসনব্যবস্থার ফ্যাসিবাদী বা স্বৈরাচারী প্রবণতার উপকরণ চিহ্নিত করে তা বিলুপ্ত করা। যেমন : এককেন্দ্রিক ক্ষমতা, দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ, পক্ষপাতমূলক নির্বাচনব্যবস্থা, নিয়ন্ত্রিত বিচার বিভাগ ইত্যাদি। গণতান্ত্রিক রীতি ও প্রক্রিয়ার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা, যেখানে জনগণের ভোট, মতামত ও অংশগ্রহণই হবে নীতিনির্ধারণের মূল ভিত্তি। ক্ষমতার ভারসাম্য ও বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করা, যাতে কোনো এক ব্যক্তি, দল বা প্রতিষ্ঠান শাসনব্যবস্থার ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে না পারে। স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও কার্যকর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গঠন করা, বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন সংস্থা, মহাহিসাব নিরীক্ষক প্রভৃতি। সাংবিধানিক সুরক্ষা ও সংশোধন প্রক্রিয়ায় জন-অংশগ্রহণ সংযুক্ত করা, যাতে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার শাসনব্যবস্থা রক্ষিত থাকে এবং জনগণের অনুমতি ছাড়া তা পরিবর্তন করা না যায়। পাশাপাশি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবে ১০টি বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে এনসিপি। এগুলো হচ্ছে-সাংবিধানিক ব্যবস্থা, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য, স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন, সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের বিধান, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সাংবিধানিক পদে নিয়োগ, নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার, দুদক সংস্কার, স্থানীয় নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার ও জনপ্রশাসন সংস্কার।
এ প্রসঙ্গে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অনানুষ্ঠানিকভাবে আমরা এরই মধ্যে অনেক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসেছি। মৌলিক সংস্কাার নিয়ে কথা বলেছি। কোনগুলো মৌলিক সংস্কার আর কেন নির্বাচনের আগেই বাস্তবায়ন করা দরকার সেটা তুলে ধরছি। দলগুলো আমাদের সঙ্গে সম্মতি দিচ্ছে। তারা বলছে, এগুলো করতে হবে। বিএনপির সঙ্গে কথা হয়েছে কি না প্রশ্নে তিনি বলেন, বিএনপির সঙ্গে এখনো কথা হয়নি। বসার ইচ্ছা রয়েছে।
মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়ন করতে গেলে প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব কি না প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা সম্ভব। মৌলিক বিষয়গুলো তো চিহ্নিত। এরই মধ্যে দলগুলোর সঙ্গে এসব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। যদি এ নিয়ে ব্যত্যয় ঘটে বা আপনাদের দাবি অনুযায়ী সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন না হয় সে ক্ষেত্রে আপনাদের কী ভূমিকা থাকবে প্রশ্নে সারোয়ার তুষার বলেন, যেগুলো একেবারে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কাঠামোর সঙ্গে সম্পৃক্ত সেগুলোর সংস্কার যেন হয় তার জন্য সর্বোচ্চ চাপপ্রয়োগ করব। অর্থাৎ মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নে আমরা সরকারের ওপর চাপপ্রয়োগ করব।
এনসিপি বলছে, মৌলিক সংস্কার স্রেফ নির্বাচনি সংস্কার নয়, এটা আসনভিত্তিক সংসদীয় দুই-তৃতীয়াংশের জোরে করা সংবিধান সংশোধনীও নয়। মৌলিক সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সাংবিধানিক ব্যবস্থার ক্ষমতার ভারসাম্য, জবাবদিহি ও বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত হবে। দলটি জানিয়েছে, বাংলাদেশের সংবিধান এবং রাষ্ট্রকাঠামোর মৌলিক সংস্কারের প্রয়োজন। যার মাধ্যমে ক্ষমতার ভারসাম্য, জবাবদিহি ও নাগরিক অধিকারের নিশ্চয়তা তথা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যায়।
এ প্রসঙ্গে দলটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন মৌলিক সংস্কারের পাঁচটি লক্ষ্য রয়েছে বলে জানান। এগুলো হচ্ছে-শাসনব্যবস্থাকে স্বচ্ছ, বিকেন্দ্রীকরণ এবং অংশগ্রহণমূলক করা; দলীয় আধিপত্য কমিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা নিশ্চিত করা; বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা ও নৈতিক শুদ্ধতা বজায় রাখা; জনগণের প্রত্যক্ষ মতামতের ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধনের বিধান চালু করা এবং তরুণ ও নারীদের রাজনীতিতে সম্পৃক্তির সুযোগ বাড়ানো। আখতার হোসেন বলেন, বাংলাদেশ যেন অতীতের মতো ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরতন্ত্র কাঠামোর মধ্যে না থেকে গণতান্ত্রিক উত্তোরণের পথে নিজেদের শামিল করতে পারে, সেই জায়গায় এনসিপির পক্ষ থেকে মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাব হাজির করেছি।
এদিকে এনসিপির দেওয়া মৌলিক সংস্কার প্রসঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া প্রস্তাবগুলোর পাশাপাশি জাতীয় নাগরিক পার্টির পক্ষ থেকে মৌলিক সংস্কারের যে রূপরেখা প্রদান করা হয়েছে তা গ্রহণ করেছি। পর্যালোচনাসাপেক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনায় এই রূপরেখার একটি প্রতিফলন পাওয়া যাবে।