আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছেন, যুগে যুগে স্বৈরশাসকের আবির্ভাব হয়েছে এবং দেশে দেশে ফ্যাসিস্টদের জন্ম হয়েছে। আমরা অ্যাডলফ হিটলারের নাম শুনেছি। মুসোলিনি, ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো, পিনোশে, মার্কোসের নাম শুনেছি। এসব ফ্যাসিস্ট ও হিটলার স্বৈরশাসকদের অনেকেই বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। সে ফ্যাসিস্টদের তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন শেখ হাসিনা। জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার গতকাল সূচনা বক্তব্যে চিফ প্রসিকিউটর এসব কথা বলেন।
বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ গতকাল এই সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এই মামলার আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ শুরু হলো। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রসিকিউটর মইনুল করিম, আবদুস সাত্তার পালোয়ান, তারেক আবদুল্লাহসহ অন্যরা। সূচনা বক্তব্য শেষে ট্রাইব্যুনালে আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের দুটি ভিডিও প্রদর্শন করা হয়। এ সময় ছেলেকে গুলি করার দৃশ্য দেখে কাঁদেন আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন। তিনি ছেলে হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দেবেন বলে জানা গেছে। আজ এই মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ধার্য রয়েছে।
এর আগে গতকাল সকালে এ মামলার গ্রেপ্তার ছয় আসামিকে কারাগার থেকে প্রিজনভ্যানে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে পুলিশ। তারা হলেন- এএসআই আমির হোসেন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়, ছাত্রলীগ নেতা ইমরান চৌধুরী, রাফিউল হাসান রাসেল ও আনোয়ার পারভেজ।
সূচনা বক্তব্যে ট্রাইব্যুনালকে উদ্দেশ করে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, আজ এক ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে আপনাদের সামনে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। এই দায়িত্ব কেবল আইনি দায়িত্ব নয়, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক দায়িত্বও, যার মাধ্যমে আমি বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে ন্যায়বিচারের জন্য কথা বলছি। ন্যায়বিচারের ধারণাটি শুধু রাষ্ট্রপক্ষই ন্যায়বিচার পাবে, ব্যাপারটি এমন নয়। আপনারা দৃশ্যত বাংলাদেশের জন্য, মানুষের জন্য, ভবিষ্যতের জন্য এমন একটি বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবেন, যা আমাদের বিচারব্যবস্থার জন্য মাইলফলক হয়ে থাকবে। তাজুল ইসলাম আরও বলেন, আমার দায়িত্ব হলো ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সংঘটিত ভয়াবহ অপরাধগুলোর নির্ভরযোগ্য তথ্য, প্রমাণ ও ঘটনার স্পষ্ট বিবরণ আপনাদের সামনে তুলে ধরা। বাংলাদেশের মানুষের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, বাংলাদেশের আগামী প্রজন্মের বসবাসের উপযোগী করার জন্য এমন একটি ন্যায়বিচার হওয়া দরকার, যাতে সমাজে খুনের রাজনীতি বন্ধ হয়।
সূচনা বক্তব্যে তাজুল ইসলাম বলেন, আমরা স্মরণ করছি সেই দুই হাজারের মতো মানুষ, যারা জীবন দিয়েছেন। এসব হত্যা, জখম সম্পর্কিত যেসব উপাদান প্রসিকিউশন আপনাদের সামনে আনবে, সেগুলো দিবালোকের মতো স্পষ্ট, স্বচ্ছ ও অকাট্য প্রমাণ যার ভিত্তিতে এই ট্রাইব্যুনাল ন্যায়সংগত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সক্ষম হবেন। কোনো ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে আমাদের কোনো ক্ষোভ নেই। আমরা অপরাধের বিচারের জন্য আপনাদের কাছে এসেছি। তিনি বলেন, নীলনকশার নির্বাচন, লাইলাতুল ইলেকশন আর আমি-ডামির নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার মসনদ আঁকড়ে ধরে বিগত ১৭ বছরে বাংলাদেশের মাটিতে খুন, গুম, রাজনৈতিক নিপীড়নের যে কালচার চালু হয়েছিল, আজ তার বিচারের ফরিয়াদি আমরা, আর আপনারা তার বিচারক। আমরা চাই, এই বিচার জাতির সভ্যতার সোপানে ন্যায়বিচারের মানদণ্ড হিসেবে স্থান পাক। যাতে আগামীর বাংলাদেশের কেউ যেন গণহত্যা চালাতে না পারে। একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পরিচয় নির্ধারিত হয় তার বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধার মাধ্যমে বলে সূচনা বক্তব্যে উল্লেখ করেন চিফ প্রসিকিউটর। তাজুল ইসলাম বলেন, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা কেবল আইনগত কর্তব্য নয়, এটি একটি নৈতিক ও ঐতিহাসিক দায়িত্ব। আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে অঙ্গীকার করছি, এই বিচারিক প্রক্রিয়ায় আসামিদের প্রাসঙ্গিক অধিকার এবং সুষ্ঠু বিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা দেওয়া হবে। সূচনা বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, এই মামলায় নিরপেক্ষ, নির্ভুল ও দৃঢ় বিচার নিশ্চিত করুন। দোষী ব্যক্তিদের যথাযথ শাস্তি দিন, যাতে জনগণের বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফিরে আসে। কারণ, আমরা এমন একটি পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে ন্যায়বিচার কেবল একটি রায় নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য একটি বার্তা। অপরাধী যত বড়ই হোক, বিচার থেকে কেউ রেহাই পাবে না। এই মামলায় কিছু আসামির অনুপস্থিতিতে বিচার কার্যক্রম চললেও তা ন্যায়বিচার থেকে বিচ্যুতি নয় উল্লেখ করে তাজুল ইসলাম বলেন, বরং এটি প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে অপরাধীর জবাবদিহি নিশ্চিত করতে আইন তার নিজস্ব গতিতে কাজ করছে। আইনের যথাযথ বিধান অনুসরণ করেই এই ট্রাইব্যুনাল অনুপস্থিত আসামিদের বিরুদ্ধেও রায় দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা রাখে।