জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে নিহত রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের লাশের ত্রুটিপূর্ণ সুরতহাল প্রতিবেদন দিতে বাধ্য করা হয় বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. তরিকুল ইসলাম। গতকাল বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ তিনি এ জবানবন্দি দেন।
ট্রাইব্যুনালকে তরিকুল বলেন, আবু সাঈদের মাথার পেছনে গুলির আঘাত ছিল। কিন্তু গুলিতে মৃত্যুর কথা না লিখতে তাকে বাধ্য করা হয়।
বর্তমানে এসআই তরিকুল ঢাকা মহানগরের ভাষানটেক থানায় কর্মরত। গত বছর ১৬ জুলাই তিনি রংপুর কোতোয়ালি থানা এলাকা ও হাসপাতালে ইউডি (অপমৃত্যু) ডিউটিতে ছিলেন। অন্যদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গতকাল পর্যন্ত ৪৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ এসব জবানবন্দি দেন সাক্ষীরা।
জবানবন্দিতে পঙ্গু হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ সিরাজুস সালেহীন জানান, জুলাই গণ অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসা নিতে আসা আহত ১৭ জনের একটি করে পা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কেটে ফেলতে হয়। আর তিনজনের একটি করে হাত অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কেটে ফেলতে হয়। এদিন এই চিকিৎসকের পাশাপাশি সিআইডির ফরেনসিক টিমের সদস্যরা বিভিন্ন অডিও-ভিডিও পরীক্ষার বিষয়ে নিজেদের জবানবন্দি তুলে ধরেন। জবানবন্দির একপর্যায়ে এজলাসে সাক্ষীদের ধমকাধমকি না করতে অনুরোধ করেন ট্রাইব্যুনাল।
আবু সাঈদের মামলার সাক্ষী এসআই তরিকুল জবানবন্দিতে আরও বলেন, গত বছর ১৬ জুলাই রংপুর কোতোয়ালি থানা এলাকায় দায়িত্ব পালনকালে বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে বেতার বার্তায় শুনতে পাই রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি লাশ আছে, তার সুরতহাল করতে হবে। পরে থানার কনস্টেবল লিটন দেবনাথসহ মেডিকেলে গিয়ে জানতে পারেন তাজহাট থানাধীন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পুলিশের গুলিতে এক ছাত্র নিহত হয়েছেন, নাম আবু সাঈদ। তিনি বলেন, তখন হাসপাতালে অনেক শিক্ষার্থী জড়ো হন এবং সেখানে উত্তেজনা বিরাজ করছিল এবং সেখানে অনেক পুলিশ সদস্য কর্তব্যরত ছিলেন। সন্ধ্যা ৭টার দিকে রংপুর মহানগর পুলিশের কোতোয়ালি জোনের সহকারী কমিশনার মো. আরিফুজ্জামান আমার কাছে জিজ্ঞেস করেন আমি লাশ দেখেছি কি না। আমি না বললে, তিনি আমাকে লাশ দেখে আসতে বলেন। তিনি বলেন, লাশ দেখে এসে আমি জানাই, লাশে অসংখ্য ছররা গুলির আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। লাশের মাথার পেছনে আঘাতের চিহ্ন ও ক্ষত স্থান থেকে রক্ত ঝরে স্ট্রেচার মাখামাখি হয়ে গেছে। তখন তিনি (সহকারী কমিশনার মো. আরিফুজ্জামান) সুরতহাল প্রতিবেদনে মৃত্যু গুলির কারণে হয়েছে বলে লেখা যাবে না বলে জানান। এই সাক্ষী আরও বলেন, তার এ কথার সঙ্গে আমি একমত না হলে তিনি আমাকে গালাগাল দেন। একপর্যায়ে বাবা-মা নিয়ে গাল দেন। এ ছাড়া আমাকে হুমকি দেন যে, তুই জামাতের দালাল, তোর চাকরি খেয়ে দেব, মামলা দিয়ে চালান করে দেব। এরপর আমি ভয় পাই। ওপর থেকে তার ওপর চাপ ছিল বলে আরিফুজ্জামান তাকে জানান বলে ট্রাইব্যুনালকে বলেন তরিকুল।
এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, রাত সাড়ে ১০টার দিকে সহকারী কমিশনার আরিফুজ্জামান মহানগর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ সাদাতসহ আসেন এবং পুনরায় তার কথামতো সুরতহাল প্রতিবেদন লিখতে বলেন। আমি উপায়ান্তর না দেখে ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ সাদাতের উপস্থিতিতে ছররা গুলির কথা বাদ দিয়ে অসংখ্য ছোট ছোট ক্ষতচিহ্ন লিখে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করি। সাক্ষ্য নেওয়ার সময় ট্রাইব্যুনালকে সহযোগিতা করেন প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম ও বি এম সুলতান মাহমুদ। পরে সাক্ষী তরিকুল ইসলামকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। এ মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আজকের দিন ধার্য করা হয়েছে।
পঙ্গু হাসপাতালে ১৭ জনের একটি করে পা কেটে ফেলতে হয়েছিল : আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল-১ এ দেওয়া জবানবন্দিতে পঙ্গু হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ সিরাজুস সালেহীন বলেন, জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা আহত ১৭ জনের একটি করে পা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কেটে ফেলতে হয়েছিল। আর তিনজনের একটি করে হাত অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কেটে ফেলতে হয়েছিল।
গতকাল বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-১ এ প্রসিকিউশনের ৪১তম সাক্ষী হিসেবে তিনি এ জবানবন্দি দেন।
জুলাই গণ অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে করা একটি মামলায় সাক্ষী হিসেবে সিরাজুস সালেহীন এ জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে সিরাজুস সালেহীন বলেন, গত বছরের ১৯ জুলাই থেকে গত বছরের ৪ আগস্ট পর্যন্ত পঙ্গু হাসপাতালে আনা আটজন মারা যান। এর মধ্যে দুজনকে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছিল। বাকি ছয়জন অস্ত্রোপচারের পর মারা যান। এ ছাড়া অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তিনজন রোগীর একটি করে হাত এবং ১৭ জনের একটি করে পা কেটে ফেলতে হয়েছিল।
এদিন এই চিকিৎসক ছাড়াও আরও পাঁচজন তাদের জবানবন্দি দেন ট্রাইব্যুনালে। এরা হলেন- ঢাকা সিএমএম আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসেন, সিআইডির কর্মকর্তা গোলাম ইফতেখারুল আলম, শেখ নজরুল ইসলাম, রুকুনুজ্জামান ও সাহেদ জোবায়ের। পরে এসব সাক্ষীকে জেরা করেন শেখ হাসিনাসহ পলাতক দুই আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। এ মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আজকের দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
দয়া করে সাক্ষীকে এজলাসে ধমকাধমকি করবেন না : এজলাসে সাক্ষীকে ধমকাধমকি করা থেকে বিরত থাকতে উভয়পক্ষের আইনজীবীদের প্রতি অনুরোধ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গতকাল বিকালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ চলাকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর সদস্য বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী এ অনুরোধ করেন।
শেখ হাসিনার মামলায় প্রসিকিউশনের ৪৪তম সাক্ষী সিআইডির ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবে কর্মরত ইন্সপেক্টর মো. রুকুনুজ্জামানের জবানবন্দি শেষ হলে বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের আইনজীবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আপনাদের সবার উদ্দেশে বলছি, এখন প্রসিকিউশনের সাক্ষী আসছে। পরে আসামিপক্ষের সাক্ষীও আসবে। আপনারা দয়া করে সাক্ষীকে এজলাসে ধমকাধমকি করবেন না। প্রয়োজনে সাক্ষীকে নামিয়ে নেবেন, বলবেন সাক্ষী প্রস্তুত না। কিন্তু সাক্ষীকে আমার সামনে ধমকাধমকি করবেন না। এটা আমি গ্রহণ করব না।
পরে প্রসিকিউশনের ৪৫ নম্বর সাক্ষী সিআইডির সাব-ইন্সপেক্টর মো. শাহেদ জুবায়েরের জবানবন্দি চলাকালে প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামীমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এই বিচারক বলেন, তামীম, বিচারে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে হবে।