মাঝে মাঝেই অস্থির হয়ে উঠছে পাহাড়। এ ছাড়া দেশের সীমান্ত দিয়ে মাদকের সঙ্গে ঢুকছে অবৈধ অস্ত্র-গোলাবারুদ। পাশাপাশি একের পর এক ঘটছে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা। চলতি মাসের ১৬ এবং ১৮ অক্টোবর চট্টগ্রামের ইপিজেডের অভ্যন্তরে মার্কিন পোশাক কারখানায় এবং শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। সর্বশেষ গতকাল রাজধানীর বিমানবন্দর রেলস্টেশনে সেনাবাহিনীর একটি দলের বনলতা এক্সপ্রেস থেকে অবৈধ অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং গান পাউডার উদ্ধারের ঘটনাটি ইঙ্গিত দিচ্ছে ভিন্ন কিছু। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর শিথিলতা এবং আগাম গোয়েন্দা তথ্যের ব্যর্থতা ভবিষ্যতে ভয়ংকর পরিস্থিতির উদ্রেক হতে পারে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সীমান্ত পেরিয়ে দেশে প্রচুর অস্ত্র ঢুকলেও তা উদ্ধারের ক্ষেত্রে খুব একটা সফলতা নেই। তবে নির্বাচনের আগে দেশে অস্থিরতা তৈরির জন্যই এসব অস্ত্র ঢোকানো হচ্ছে এটা অনেকটাই পরিষ্কার। যদিও বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্বরত কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে কোনো সন্দেহজনক অপরাধীর কাছ থেকে তথ্য আদায় করা কঠিন হয়ে পড়ছে। আইন অনুযায়ী কারও গায়ে স্পর্শ করা যায় না। এ কারণে অনেক সফলতা থেকেও বঞ্চিত হতে হচ্ছে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে বলছেন তারা। জানা গেছে, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, কক্সবাজারের টেকনাফ, কুমিল্লা, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও চুয়াডাঙ্গাসহ সীমান্তের অন্তত ১৭টি পয়েন্ট দিয়ে অবৈধ অস্ত্র দেশে প্রবেশ করছে। তবে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র ঢুকছে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুমিল্লা-আখাউড়া সীমান্ত এবং বাংলাদেশ-মিয়ানমার ২৭১ কিলোমিটারের সীমান্তের সাতটি পথে। এ পয়েন্টগুলোর মধ্যে রয়েছে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের বাইশফাঁড়ি, ঘুমধুম পয়েন্টের বালুখালী কাস্টমস ঘাট ও উখিয়ার পালংখালী এবং হোয়াইক্যং ইউনিয়নের নলবনিয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এখনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর শিথিলতা লক্ষ্যণীয়। এটা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও নাজুক হতে পারে। এখনো লুট হওয়া পুলিশের অস্ত্রগুলোও উদ্ধার হয়নি। গতকাল রাজধানীর বিমানবন্দর রেলস্টেশনে রাজশাহী থেকে আসা একটি ট্রেন থেকে ৮টি বিদেশি পিস্তলসহ বিপুল আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনী। বেলা সোয়া ১১টার দিকে বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেনের খ নম্বর বগির ১ নম্বর কেবিনে পরিত্যক্ত অবস্থায় একটি ট্রলি ব্যাগে এগুলো পাওয়া যায়। ট্রলি ব্যাগ থেকে পিস্তল ছাড়াও ১৬টি ম্যাগাজিন, ২৬ রাউন্ড অ্যামুনিশন, ২.৩৯ কেজি গান পাউডার ও ২.২৩ কেজি প্লাস্টিক বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় সন্দেহভাজন চারজনকে আটক করা হয়েছে। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। আইএসপিআর জানায়, সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে গোয়েন্দা সংস্থা ও রেলওয়ে পুলিশের সহায়তায় বিমানবন্দর রেলস্টেশনে একটি বিশেষ অভিযান চালানো হয়। রেলওয়ে পুলিশের ঢাকা জেলার এসপি আনোয়ার হোসেন বলেন, ঘটনায় জড়িত কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। অস্ত্র, গুলি ও বিস্ফোরকগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। সে ক্ষেত্রে ঢাকা রেলওয়ে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হবে। প্রাথমিকভাবে আমরা ধারণা করছি, ট্রলি ব্যাগটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে তোলা হয়ে থাকতে পারে। র্যাব-৫ অধিনায়ক লে. কর্নেল মাসুদ পারভেজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। গতকাল ৬৪০ গ্রাম হেরোইনসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা সিরাজগঞ্জ থেকে এসে হেরোইনের চালান নিয়ে যাচ্ছিল।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমানে পুরোপুরি আইন অনুযায়ী সন্দেহজনক অপরাধীদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে হচ্ছে। আইন অনুযায়ী কাউকে গায়ে স্পর্শ করা যাবে না। অপরাধীরাও এর সুযোগ নিচ্ছে। এর আগে গত ৫ অক্টোবর ভোর রাতে কক্সবাজারের উখিয়া সীমান্তের পালংখালী ইউনিয়নের মরা গাছতলায় উখিয়া থানার পুলিশ অভিযান চালিয়ে দুটি অগ্নেয়াস্ত্র, পাঁচটি কার্তুজ ও ২ হাজার ইয়াবাসহ পাঁচ মাদক কারবারিকে আটক করে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমার থেকে যেভাবে অস্ত্র ঢুকছে এরকম পরিস্থিতি কয়েক বছর আগেও ছিল না। এখন মাদকের সঙ্গেও আনা হচ্ছে অস্ত্র। আবার মানব পাচারকারী চক্রও জড়িয়েছে অস্ত্র কারবারে। কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. সাইফউদ্দীন শাহীন বলেন, বর্তমানে পাচারকারীরা অস্ত্র এবং মাদক একসঙ্গেই নিয়ে আসছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় মিয়ানমার থেকে সহজেই অস্ত্র পাচার করা সংশ্লিষ্ট চক্রের সদস্যদের জন্য সহজ হয়ে উঠেছে। গত ১২ অক্টোবর সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সীমান্ত দিয়ে দেশে অবৈধ অস্ত্র ও কালো টাকা আসছে বিষয়টি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর বাইরে একাধিক সংস্থার প্রতিবেদেন উঠে এসেছে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার জন্য ষড়যন্ত্র করছে দেশিবিদেশি চক্র। এর কয়েক দিনের ব্যবধানেই একের পর এক ঘটেছে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। বিশেষ করে গত ১৮ অক্টোবর বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আগুন সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক আবু নাঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ অনেক ফায়ার বিশেষজ্ঞ ওই ঘটনা এবং এর মাত্র দুই দিন আগের সিইপিজেডে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডকে নাশকতা বলছেন। এরপরই কেপিআইয়ের (গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা) নিরাপত্তা নিয়ে নড়েচড়ে বসে সরকারের শীর্ষ মহল। এর বাইরে গত ২৪ অক্টোবরও রাজধানীর মিরপুরে একটি কমিউনিটি সেন্টারে আগুনের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা দুই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ওই ঘটনাটিও নাশকতা কি না তা নিয়ে এখনো তদন্ত চলছে। এর আগে গত ২৭ ডিসেম্বর সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে লাগা আগুনে পুড়ে যায় গুরুত্বপূর্ণ অনেক নথি। ওই ভবনে ছিল অর্থ মন্ত্রণালয়, এলজিইডি মন্ত্রণালয়, রেল এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি বিভাগ। এ ঘটনায় একাধিক তদন্ত কমিটি হলেও তা নাশকতার প্রকৃষ্ট কারণ চিহ্নিত করতে পারেনি। তারা দাবি করেছিলেন, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটের মাধ্যমে আগুনের সূত্রপাত হয়। গত ২২ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে ৩টার দিকে গাজীপুরের টঙ্গী বিসিক এলাকায় সাহারা সুপার মার্কেটের পাশে ফেমাস কেমিক্যালস লিমিটেড নামে একটি টিনশেড সেমিপাকা গোডাউনে ভয়াবহ আগুন লাগে। আগুন নির্বাপণের কাজ করার সময় তিনজন ফায়ার ফাইটার ও একজন পথচারীর নির্মম মৃত্যু হয়।