রাজধানীর বনানী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন নজরুলসংগীতের মুকুটহীন সম্রাজ্ঞী ফিরোজা বেগম। বুধবার বাদ আসর গুলশানের আজাদ মসজিদের সামনে জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
এর আগে তাঁর মরদেহে সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বুধবার বেলা দুইটার দিকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফিরোজা বেগমের মরদেহ রাখা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে মরহুমার কফিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পক্ষে ফুল দেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খানসহ কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা।
এছাড়াও শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি প্রমুখ।
বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে ব্যারিস্টার রফিক উল হক, শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামান, কাজী নজরুল ইসলামের নাতনি খিলখিল কাজী প্রমুখ মরহুমার কফিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ ছাড়া বাংলা একাডেমি, নজরুল একাডেমি, ছায়ানটসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকেও শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
এর আগে সকাল আটটায় হাসপাতালের হিমঘর থেকে ফিরোজা বেগমের মরদেহ ইন্দিরা রোডের বাসভবনে নেয়া হয়। সেখানে গণমাধ্যমের অসংখ্য কর্মীসহ মরহুমার ভক্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা ভিড় করেন। সেখান থেকে মরদেহ নেওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।
গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে আটটার দিকে রাজধানীর এ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন নজরুলের গানের পাখি ফিরোজা বেগম। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। ফিরোজা বেগমের মৃত্যুতে শোক জানান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।
এছাড়া বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াও শিল্পীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেন। মৃত্যুকালে তিন ছেলে তাহসিন, সঙ্গীত তারকা হামিদ আহমেদ ও সাফিন আহমেদ এবং পুত্রবধূ কানিজ সুবর্ণাসহ অসংখ্যা গুণগ্রাহী রেখে গেছেন তিনি। ফিরোজা বেগম অনেকদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন।
ফিরোজা বেগমের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
১৯৩০ সালের ২৮ জুলাই ফরিদপুরের এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ফিরোজা বেগম। বাবা খান বাহাদুর সাহেব মোহাম্মদ ইসমাইল ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের প্রথম মুসলমান কৌঁসুলি। মা বেগম কাওকাবুন্নেসা। তিন ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয় সন্তান।
৬৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে সংগীত সাধনা করেছেন ফিরোজা বেগম। এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে গান গাইতে গিয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে পরিচিত হন তিনি। নজরুলের গান নিয়ে সারা বিশ্বে ঘুরেছেন। অল ইন্ডিয়া রেডিওতে নজরুলের গান প্রচারে অবদান রয়েছে তার।
নজরুলসংগীতের প্রথম ‘লংপ্লে’তে তাঁর কণ্ঠে দু’টি গান রয়েছে। তালাত মাহমুদের প্রথম ঢাকা সফরের সঙ্গী ছিলেন ফিরোজা বেগম। রেডিওতে বড়ে গুলাম আলী খাঁ সাহেবের সঙ্গে ঠুমরি গাওয়ার অভিজ্ঞতাও আছে তাঁর ঝুলিতে।
দেশ বিভাগের পর পরিবারসহ ১৯৬৭ সালে ঢাকায় এসে নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েন শিল্পী ফিরোজা বেগম। পকিস্তান সরকার তাকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ত্যাগের নির্দেশ দেয়।
নজরুল সংগীতশিল্পী হলেও ফিরোজা বেগম রবীন্দ্রসংগীত, আধুনিক গান, ইসলামিক গান, লোকগানও গেয়েছেন। গ্রামোফোন রেকর্ড ছাড়াও রেডিও, টেলিভিশনে প্রচার হয়েছে তার অসংখ্য গান।
তবে চলচ্চিত্রের প্লেব্যাকে কখনও আগ্রহবোধ করেননি। গ্রামোফোন কোম্পানির জন্য গান রেকর্ডিংয়ের কাজ করতে গিয়ে তার পরিচয় হয় সংগীত পরিচালক কমল দাশগুপ্তের সঙ্গে। ১৯৫৬ সালে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন তারা। কলকাতাতেই জন্মেছে তার তিন সন্তান তাহসিন, হামিন ও শাফিন। ১৯৭৪ সালে মারা যান স্বামী কমল দাশগুপ্ত।
বিভিন্ন সময়ে নানা সম্মাননা পেয়েছেন ফিরোজা বেগম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্বাধীনতা পুরস্কার, শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, শ্রেষ্ঠ টিভি শিল্পী পুরস্কার (পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ), নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক, স্যার সলিমুল্লাহ স্বর্ণপদক, দীননাথ সেন স্বর্ণপদক, সত্যজিৎ রায় স্বর্ণপদক, বাচসাস পুরস্কার, সিকোয়েন্স পুরস্কার প্রভৃতি।