বেতন ছাড়ে অর্থ মন্ত্রণালয় আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠি চালাচালির মাঝখানে পড়ে দেশের একহাজার ৭৩০ জন আইসিটি শিক্ষক মানবেতর জীবন যাপন করছেন। দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা প্রায় দ্বিগুণ হলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগদানের প্রায় ৬ বছরেও ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি এসব শিক্ষকদের। আইসিটি শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘদিন বেতন-ভাতা না পেয়ে তাদের কাটাতে হচ্ছে এ্যানালগ জীবন। না পারছেন চাকরি ছাড়তে, না পারছেন দু'বেলা দু'মুঠো খাবার তুলে দিয়ে পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফোটাতে।
দেশব্যাপী দীর্ঘ আন্দোলন আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আশ্বাস পাওয়ার পরও দীর্ঘ প্রায় ৬ বছরেও মেলেনি বেতন। পরিবারের শিশু-সন্তানসহ অন্যান্য সদস্যদের মুখে হাসি ফোটানোর আন্তরিক চেষ্টা থাকলেও বেতন না পাওয়ায় বুকের মধ্যে তীব্র যন্ত্রণা আর ক্ষোভ নিয়ে দিনাতিপাত করছেন আইসিটি শিক্ষকরা।
তথ্যমতে, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে কম্পিউটার শিক্ষা চালু করেন। সে সময় কম্পিউটার বিষয়ে নিয়োগকৃত প্রায় ১২ হাজার শিক্ষকের বেতন ভাতাও প্রদান করা হয়। পরবর্তিতে আবারও ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সালের ১৩ নভেম্বর দেশব্যাপী বেশ কিছু কম্পিউটার শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। এরপর ২০১২ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়টি আবশ্যিক বিষয় হিসেবে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই বিষয়টি পড়ানোর জন্য দায়িত্ব পান কম্পিউটার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা। কিন্তু আজ পর্যন্ত এই নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা বেতন পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন। বর্তমানে নাটোরে বেতন না পাওয়া এসব আইসিটি শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় অর্ধশত আর সারা দেশে একহাজার ৭৩০ জন।
সিংড়া উপজেলার বৃষ্ণপুর ইটালী মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের আইসিটি শিক্ষক মশিউর রহমান জানান, তার পরিবারের ৭ ভাই ২ বোনের মধ্যে তিনি ৫ নম্বর। ২০০৫ সালে তিনি বগুড়ার আজিজুল হক কলেজ থেকে এমএ পাশ করার পর ২০১২ সালের শেষের দিকে নিয়োগ পান। পরিবারের শিক্ষিত ছেলে হিসেবে তার ওপর অন্য সকল সদস্যরাই বিভিন্ন আশা করে থাকেন কিন্তু বেতন না পাওয়ায় তিনি তার পরিবারের বড় ও ছোটদের কাছে প্রত্যাশিত আদর বা শ্রদ্ধার পরিবর্তে তিরস্কারের পাত্র হয়েছেন। এমনকি তার স্ত্রী ও ৬ বছর বয়সের একমাত্র ছেলে সোয়াইর মাঝে মাঝে কিছু আবদার করলেও তিনি তা পূরণ করতে পারেন না। এটা যে কত কষ্টের তা বলে বোঝানো যাবে না। তিনি বলেন, একজন অশিক্ষিত দিন মজুরও দিন শেষে টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরে। পরিবারের সদস্যদের ছোট-খাটো দাবি পূরণ করতে পারেন। কিন্তু তিনি এমএ পাস করেও তা পারেন না।
সিংড়া বাজারের বালুয়া-বাসুয়া এলাকার আলহাজ্ব আব্দুর রহিম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের আইসিটি শিক্ষক রুখসানা পারভীন জানান, ২০১৪ সালে তিনি নিয়োগ পান। তাদের যৌথ পরিবারে স্বামীসহ মোট সদস্য আটজন। পরিবারে তার স্বামীই এখন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার স্বামী একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। বহু কষ্টে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে বুঝিয়ে তিনি চাকুরিতে যোগদান করেছিলেন। তার বর্তমানে এক ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলেটি স্থানীয় ইংলিশ মিডিয়াম বিয়াম স্কুলের ছাত্র। পরিবারের লোকজন আশা করেছিলেন, চাকুরি করে তিনি পরিবারের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কিছুটা সহায়তা করতে পারবেন। ছেলে-মেয়ের শখ পূরণ করবেন। কিন্তু দীর্ঘদিন চাকুরি করেও আজ পর্যন্ত তার বেতন পাশ হয়নি। মাঝে মাঝেই স্বামী ও পরিবারের লোকজন বিরক্ত হয়ে তাকে চাকুরি ছাড়তে বলেন।
এক প্রশ্নের জবাবে রুখসানা পারভীন বলেন, বাংলাদেশের শিক্ষা বিস্তারে বর্তমান সরকারের ভূমিকা অনন্য। দেশের সকল শিক্ষকদের বেতন দিগুণ করেই এই সরকার সন্তুষ্ট হয়নি বরং শিক্ষকদের উৎসব পালনের কথা চিন্তা করে সম্প্রতি প্রায় ৬শ' কোটি টাকা উৎসব ভাতা বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ বানানোর অঙ্গীকারে আবদ্ধ যে সকল কম্পিউটার শিক্ষক নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন, তাদের মধ্য একহাজার ৭৩০জন শিক্ষককে বঞ্চিত রেখেছে সকল সুবিধা থেকে।
বিষয়টি সম্পর্কে বাংলাদেশ এমপিও বঞ্চিত আইসিটি শিক্ষক সংগঠনের সভাপতি আশিকুজ্জামান বলেন, এমপিও বঞ্চিত আইসিটি শিক্ষকদের বেতন চালুর দাবিতে তারা সংগঠনের পক্ষ থেকে গত বছর ঢাকায় দীর্ঘ ২৩ দিন আন্দোলন করেছিলেন । এসময় শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ওয়াহেদুজ্জামান স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সমস্যাটি সমাধানে তাদের আশ্বস্ত করেছিলেন। কিন্তু সে আশ্বাস এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, সারা দেশে ১ হাজার ৭৩০ জন আইসিটি শিক্ষকের বেতন ছাড়ের বিষয়টি এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তদন্তাধীন বলে তিনি শিক্ষামন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র থেকে সম্প্রতি শুনেছেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি। অর্থ মন্ত্রণালয় আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠি চালাচালির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে বিষয়টি।
তিনি দাবি করেন, গত ২৩ ফেব্রুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে চিঠি প্রেরণ করে। আর ১ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর ও মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরকে চিঠি প্রদান করে।
এর প্রেক্ষিতে গত ৯ এপ্রিল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ওয়াহেদুজ্জামান স্বাস্বরিত এক চিঠিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানানো হয় যে, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মোট আইসিটি নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের সংখ্যা ৮ হাজার ৯২৫ জন। এদের মধ্যে বেতন পান ৭ হাজার ৭০৩ জন। বেতন পান না একহাজার ২২২ জন। দেশের কলেজ পর্যায়ে মোট আইসিটি বিষয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকের সংখ্যা একহাজার ৫৭৪ জন। এদের মধ্যে বেতন পান একহাজার ৩৯২ জন। অপরদিকে বেতন পান না ১৮২ জন। মাদ্রাসাগুলোতে আইসিটি বিষয়ে মোট নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের সংখ্যা ৩ হাজার ৬৬ জন। এদের মধ্যে বেতন পান ২ হাজার ৭৭৩ জন। আর বেতন পান না ২৯২ জন। সবমিলিয়ে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বেতন না পাওয়া আইসিটি শিক্ষকদের সংখ্যা একহাজার ৭৩০ জন।
বিডি-প্রতিদিন/এস আহমেদ