১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০৬:৫০

পুরোনো পথ শুধু পুরোনো গন্তব্যেই নিয়ে যেতে পারে, ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের প্রফেসর ইউনূস

অনলাইন ডেস্ক

পুরোনো পথ শুধু পুরোনো গন্তব্যেই নিয়ে যেতে পারে, ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের প্রফেসর ইউনূস

নয়াদিল্লীতে দুই দিনের সফরকালে নোবেল লরিয়েট প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে “ন্যাশনাল ইনস্টিটিউশন ফর ট্রান্সফরমিং ইন্ডিয়া”- যা “নীতি আয়োগ” নামে বহুল পরিচিত - এর উপদেষ্টা, গবেষক ও উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। 

উল্লেখ্য, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা অমিতাভ কান্তর নেতৃত্বে সংস্থাটি ভারত সরকারের সর্বোচ্চ “থিংক ট্যাংক” বা নীতি নির্ধারণী সংস্থা যা ভারত সরকার কর্তৃক “টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ” অর্জনে দিক-নির্দেশনা ও নীতি নির্ধারণ উভয় ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভারতের পরিকল্পনা কমিশনকে প্রতিস্থাপিত করে এই সংস্থাটি সৃষ্টি করা হয়।

কান্ত প্রফেসর ইউনূসকে উপস্থিত সত্তরজন শীর্ষ বিশেষজ্ঞের নিকট পরিচয় করিয়ে দেন এবং বিশ্বব্যাপী দারিদ্র ও পরিবেশগত সমস্যার মোকাবেলায় ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসার ভূমিকা বিষয়ে প্রফেসর ইউনূসকে তার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরতে অনুরোধ জানান। 

প্রফেসর ইউনূস সম্পদ কেন্দ্রীকরণ, বেকারত্ব ও পরিবেশ’ এই তিন বিষয়ে তাঁর উদ্বেগ তুলে ধরেন। তিনি অর্থনীতির তাত্তি¡ক কাঠামো পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে কীভাবে একটি “তিন শূন্য” অর্থাৎ শূন্য দারিদ্র, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য নীট কার্বন নিঃস্বরণের পৃথিবী গড়ে তোলা যায় তা ব্যাখ্যা করেন এবং বলেন যে, অর্থশাস্ত্রকে একটি সত্যিকার সামাজিক বিজ্ঞানে পরিণত হতে হলে এই পুনর্বিন্যাস খুব জরুরি। তার বক্তৃতার পর শুরু হয় এক দীর্ঘ প্রশ্নোত্তর পর্ব।

তার নীতি আয়োগ পরিদর্শনের সময় প্রফেসর ইউনূস “অটল ইনোভেশন মিশন” (এআইএম) এর প্রধান নির্বাহী আর. রামাননের সাথে পৃথক বৈঠক করেন। 

উল্লেখ্য, এআইএম নীতি আয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা যার একজন নিজস্ব প্রধান নির্বাহী রয়েছে। ভারতে উদ্ভাবন ও ব্যবসায় উদ্যোগের সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এটি ভারত সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। এর লক্ষ্য ভারতীয় অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে উদ্ভাবনকে ত্বরান্বিত করতে নতুন নতুন কর্মসূচি ও নীতি প্রণয়ন করা, বিভিন্ন অংশীজনের জন্য প্লাটফরম ও পারস্পরিক সহযোগিতার সুযোগ তৈরী করে দেয়া এবং ভারতে উদ্ভাবন ইকোসিস্টেম তদারকি করতে একটি সার্বিক অবকাঠামো তৈরী করা।

প্রফেসর ইউনূস রামাননের সাথে এক দীর্ঘ বৈঠক করেন। ভারতে সামাজিক ব্যবসা প্রসারের লক্ষ্যে গঠিত “ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস ইন্ডিয়া”র সাথে রামানন ইতোমধ্যেই চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। এই চুক্তির অধীনে ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস ইন্ডিয়া অটল ইনোভেশন মিশনকে তার বিভিন্ন সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগ ডিজাইন করতে সহায়তা করবে। তাঁরা সংস্থাটির শাখা অটল টিংকারিং ল্যাবের একটি কর্মসূচি চালু করার বিষয়ে আলোচনা করেন যার লক্ষ্য ভারতীয় স্কুল সিস্টেমে ছাত্রদের মধ্যে সমস্যা সমাধানের মনোবৃত্তি সৃষ্টি করা।

প্রফেসর ইউনূস অটল ইনোভেশন মিশনের তরুণ পেশাদার কর্মসূচির সদস্যদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন ও তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। রামানন এই সেশনে সভাপতিত্ব করেন। ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস ইন্ডিয়া স্কুলগুলোতে টিংকারিং ল্যাবের কাঠামোর মধ্যে ছাত্রদের মধ্যে সামাজিক ফিকশন সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করবে।

নোবেল লরিয়েট প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ভারতে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর অ্যাসোসিয়েশন “সা-ধান” এর ২০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন এবং সম্মেলন উদ্বোধন করেন।

 ভারতে সকল ধরনের ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান যেমন ব্যাংক, এনজিও, সমবায় সমিতি সা-ধান এর সদস্য। ভারতের নেতৃস্থানীয় প্রায় সকল ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান সহ এর সদস্য সংখ্যা বর্তমানে ২৫১। উল্লেখ্য যে, ভারতের ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সদস্য সংখ্যা এখন প্রায় ৫ কোটি যার ৯৯ শতাংশ মহিলা। প্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বমোট ঋণের স্থিতি প্রায় ১ লাখ কোটি রুপি।

এ বছরের সম্মেলনের মূল বিষয়বস্তু ছিল “ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে অনানুষ্ঠানিক খাতের প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিতকরণ।”

প্রফেসর ইউনূস তার ভাষণে গত ২০ বছরে ক্ষুদ্রঋণ খাতের বিপুল প্রসার এবং ব্যাপক সংখ্যক দরিদ্র মানুষের কাছে মানসম্মত ক্ষুদ্রঋণ সেবা পৌঁছে দেবার জন্য সা-ধান -কে অভিনন্দন জানান।

তিনি বলেন যে, ক্ষুদ্রঋণ ভারতের গ্রামাঞ্চলে লাখ লাখ দরিদ্র নারীকে উদ্যোক্তায় পরিণত করেছে। এটা ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতিকে শহরের অর্থনীতির জন্য শ্রম সরবরাহকারীর ভূমিকা থেকে বেরিয়ে এসে বরং শহরের অর্থনীতির সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবার মাধ্যমে গ্রাম থেকে শহরে তরুণদের অভিবাসনের গতি কমিয়ে এনেছে। 

তিনি আরও বলেন, ভারতে ক্ষুদ্রঋণের বিকাশের যে গতি তাতে আগামী পাঁচ বছরে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সদস্য সংখ্যা ২০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে এবং ঋণের স্থিতি এ সময়ে দ্বিগুণ হয়ে যাবে। ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণের অভিঘাত পুরোপুরি দৃশ্যমান হবে। তিনি ক্ষুদ্রঋণের সাথে যুক্ত নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে আর্থিক খাতের বাইরে অন্য খাতগুলো যেমন স্বাস্থ্যসেবা, পানীয় জল, আবাসন, কৃষি-প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, খুচরা বিক্রয়, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, হস্তশিল্প, গ্রীন এনার্জি ইত্যাদি খাতে সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে তাদের উদ্যোগ প্রসারিত করতে আহ্বান জানান। তিনি বাংলাদেশে সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে এসব খাতের বিকাশের উদাহরণ তুলে ধরেন।

ক্ষুদ্রঋণ নেতৃবৃন্দ ছাড়াও রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, ন্যাশনাল ব্যাংক ফর এগ্রিকালচার এন্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট এবং স্মল ইন্ডাষ্ট্রিজ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। প্রফেসর ইউনূসকে সা-ধান কর্তৃক প্রস্তুতকৃত “ভারত মাইক্রোফাইনান্স রিপোর্ট ২০১৯” আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করতে আমন্ত্রণ জানান হয়। রিপোর্টটি সমগ্র ভারতের ক্ষুদ্রঋণ খাতের একটি বিস্তারিত বিবরণ এবং এই খাতে ভারতের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্যের উৎস।

সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় নয়াদিল্লির ইন্ডিয়া হাবিটাট সেন্টারে। দু’দিন ব্যাপী এই সম্মেলনে ভারতের সকল এলাকা থেকে ৫ শতাধিক প্রতিনিধি যোগ দেন।

এছাড়াও প্রফেসর ইউনূসকে “ফেসবুক ইন্ডিয়া” কার্যালয়ে বক্তব্য রাখতে আমন্ত্রণ জানানো হয় যেখানে তিনি প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ বিষয়ে তার চিন্তা-ভাবনা এবং আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের উত্থান নিয়ে তার উদ্বেগ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, অনিয়ন্ত্রিত ও সামাজিক দিক-নির্দেশনাহীন থাকলে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স পৃথিবী থেকে মানবজাতিকে বিলুপ্ত করে দেবে।

১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ প্রফেসর ইউনূস ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন।

বিডি প্রতিদিন/কালাম

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর