দেশজুড়ে নতুন করে উৎকণ্ঠা তৈরি করছে করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন। এক সপ্তাহের মধ্যে দ্বিগুণ হয়েছে করোনা শনাক্তের হার। সংক্রমণ ঠেকাতে সক্ষমতা বাড়ানো এবং প্রতিরোধে জোর দিচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এর মধ্যেই দেওয়া হয়েছে ১৫ দফা নির্দেশনা। রোগী বাড়লে পরিস্থিতি সামলাতে প্রস্তুত রয়েছে হাসপাতাল।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ওমিক্রন সংক্রমণ প্রতিরোধে আমরা দুটি বিষয়ে জোর দিয়ে কাজ করছি। প্রথমত আমাদের সক্ষমতা বাড়ানো এবং দ্বিতীয়ত প্রতিরোধ। সংক্রমণ কমাতে যে ১৫ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তার বাস্তবায়নে কাজ চলছে। সবাইকে এই নির্দেশনাগুলো মেনে চলতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্থলবন্দর, বিমানবন্দর, নৌবন্দরে স্ক্রিনিং বাড়ানো হয়েছে। সীমান্তবর্তী এলাকায় কোয়ারেন্টাইন জোরদার করতে বলা হয়েছে। এটা নজরদারি করবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কোনো ব্যক্তি দেশে আসার সময় অ্যান্টিজেন্ট টেস্ট পজিটিভ থাকলে তার আরটি-পিসিআর টেস্ট করতে হবে। আরটি-পিসিআর টেস্টে পজিটিভ এলে তাকে অবশ্যই প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। আক্রান্ত দেশ থেকে এলে, নেগেটিভ সনদ থাকলে তারা নিজ বাড়িতে পর্যবেক্ষণে থাকবে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, গতকাল দেশে করোনা শনাক্তের হার ছিল ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ২০ হাজার ২০৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১ হাজার ১৪৬ জনকে করোনা পজিটিভ শনাক্ত করা হয়েছে। মারা গেছেন একজন। গত ২৭ ডিসেম্বর ৩৭৩ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে, মারা গেছেন একজন। শনাক্ত হার ২ দশমিক ১৬ শতাংশ। গত ১ জানুয়ারি করোনা শনাক্তের হার ছিল ২ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ১৫ হাজার ২১৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৩৭০ জনের করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে। মারা গিয়েছিলেন চারজন। শনাক্তের হার খেয়াল করলে দেখা যায় এক সপ্তাহে দ্বিগুণ হারে বেড়েছে করোনা শনাক্তের হার। ডিসেম্বরের শুরু থেকেই ঊর্ধ্বমুখী করোনা সংক্রমণের হার। এর মধ্যে নতুন ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ায় দেখা দিয়েছে দুশ্চিন্তা। জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ে দেশে ২০ জনের শরীরে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। আক্রান্তের হার বাড়ায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে হাসপাতালগুলো। রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে কভিড-১৯ রোগীদের জন্য নির্ধারিত ৪ হাজার ৬১৬টি শয্যার মধ্যে ৪ হাজার ২০৫টিই ফাঁকা রয়েছে। কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ৬৪ শয্যার মধ্যে ৪৭টি ফাঁকা রয়েছে। ১৬টি কভিড আইসিইউর মধ্যে ফাঁকা রয়েছে ১৫টি। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ২৭৫ শয্যার মধ্যে ১৯০টি ফাঁকা রয়েছে। ১০টি আইসিইউর একটি ফাঁকা আছে। শেখ রাসেল গ্যাসট্রোলিভার হাসপাতালে ১৭৪টি শয্যা এবং ১৬টি আইসিইউর সবগুলো ফাঁকা রয়েছে। কভিড আক্রান্ত বাড়তে থাকায় হাসপাতালে বাড়ছে ভর্তি রোগীর সংখ্যা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী কমে আসায় হাসপাতালগুলোতে নির্দিষ্ট সংখ্যক শয্যা রেখে নন-কভিড রোগীদের সেবা দেওয়া হচ্ছে। করোনা আক্রান্ত রোগী বাড়লে আবার আগের মতো হাসপাতালগুলোতে কভিড রোগীদের সেবা দেওয়া হবে। প্রস্তুতি সবই রয়েছে। অক্সিজেন সিলিন্ডার, সেন্ট্রাল অক্সিজেন, শয্যা সবই রয়েছে। ডিএনসিসি কভিড হাসপাতাল এবং বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব ফিল্ড হাসপাতাল চালু আছে। তিনি আরও বলেন, প্রায় দুই বছরে রোগী ব্যবস্থাপনায় আমাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে। অন্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যু অনেক কম ছিল। এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমরা রোগীদের পর্যাপ্ত সেবা নিশ্চিত করতে পারব।’ করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন ঠেকাতে সারা দেশে ১৫ দফা নির্দেশনা জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। যেখানে সব ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে জনসমাগমে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। পাশাপাশি পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্র, কমিউনিটি সেন্টার ও রেস্তোরাঁয় মানুষের উপস্থিতি ধারণ ক্ষমতার অর্ধেকের মধ্যে সীমিত রাখতে বলা হয়েছে।
সভা-সমাবেশ বন্ধসহ চার সুপারিশ কারিগরি কমিটির : দেশে মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপ অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকায় তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সব ধরনের সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ বন্ধের সুপারিশ করেছে করোনাসংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপ বাস্তবায়নে প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট পরিচালনারও সুপারিশ করেছে কমিটি। গতকাল রাতে কভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি কমিটির ৫০তম সভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়। কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সভায় নিম্নলিখিত সুপারিশগুলো নেওয়া হয়েছে- ১. পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ সারা বিশ্বে কভিড-১৯ এর সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আমাদের দেশেও সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। সভা আবার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি ওই কর্মসূচি বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েছে। প্রয়োজনে কর্মসূচি বাস্তবায়ন নিশ্চিতকরণের জন্য আইনি ব্যবস্থা যেমন মোবাইল কোর্ট পরিচালনার পরামর্শ দেয় কমিটি। শতভাগ সঠিকভাবে মাস্ক পরা নিশ্চিত করা, হাত পরিষ্কার রাখা ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। বিভিন্ন স্থানে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতের উদ্দেশ্যে সব সামাজিক (বিয়ের অনুষ্ঠান, মেলা ইত্যাদি) ধর্মীয় (ওয়াজ মাহফিল) ও রাজনৈতিক সমাবেশ এ সময় বন্ধ করতে হবে। সভা/কর্মশালার ব্যবস্থা অনলাইনে করা প্রয়োজন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতকরণ ও নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংক্রমণের বিষয়ে নিয়মিত নজরদারির বিষয়ে পরামর্শক কমিটি গুরুত্বারোপ করে। ২. শিক্ষার্থীসহ সবাইকে দ্রুত ভ্যাকসিনের আওতায় আসতে হবে। ৩. সব পয়েন্ট অব অ্যান্ট্রিতে স্কিনিং, কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশন আরও জোরদার করার সুপারিশ করা হয়। ৪. সংক্রমণ বেড়ে গেলে তা মোকাবিলায় হাসপাতাল প্রস্তুতি বিশেষ করে পর্যাপ্ত সাধারণ ও আইসিইউ শয্যা, পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা রাখার পরামর্শ দেয় কমিটি।
করোনাভাইরাসের প্রকোপ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসার পর গত কয়েক দিন ধরে অব্যাহতভাবে সংক্রমণ বাড়ছে। ইতোমধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকায় আবিষ্কৃত করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন বাংলাদেশেও শনাক্ত হয়েছে। ওমিক্রন এখনো দেশে ভয়াবহ রূপ ধারণ না করলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্যারিয়েন্টটি ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে।
সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে করোনা বিধিনিষেধ জারি করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকালও জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কে দেশবাসীকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং টিকাকরণের আওতায় আসার পরামর্শ দিয়েছেন সরকারপ্রধান।
বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ