কালজয়ী একুশে গানের রচয়িতা, প্রখ্যাত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আবদুল গাফফার চৌধুরী আর নেই। আজ বৃহস্পতিবার লন্ডনের বার্নেট হাসপাতালে স্থানীয় সময় ভোর ৬টা ৪০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
গত ১৫ই মার্চ বাংলাদেশ প্রতিদিনের ১৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর বিশেষ সংখ্যায় প্রখ্যাত এই লেখক ও সাংবাদিকের শেষ লেখা প্রকাশিত হয়। পাঠকদের জন্য ‘যুগের হাওয়ায় বাংলাদেশ প্রতিদিন’ শিরোনামের সেই লেখাটি আবারও তুলে ধরা হলো :
‘যুগের হাওয়ায় বাংলাদেশ প্রতিদিন’
আবদুল গাফফার চৌধুরী
বাংলাদেশ প্রতিদিন আজ ১২ বছর পূর্ণ করল। মহাকালের ঘূর্ণাবর্তে ১২ বছর একটি ক্ষণিক বুদবুদের মতো। কিন্তু এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে মেধা ও মনন আর বয়স দিয়ে মাপা চলে না। এ যুগে তার দ্রুত বৃদ্ধি বয়সকে হার মানায়।
বাংলাদেশ প্রতিদিন বয়সে ১২ বছর পেরিয়েছে। কিন্তু দেশের সংবাদ-সাহিত্যে তার পদচারণ এক নির্ভার যুবকের মতো। ভীরু কিশোরের মতো নয়। সংবাদ-সাহিত্য কথাটাও এখন আর নতুন কিছু নয়। আগে সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের মধ্যে একটা পার্থক্য ছিল। এখন সাহিত্য ও সাংবাদিকতা দুই সহোদরার মতো। সাহিত্য এখন সাংবাদিকতাকে রস জোগায়। সাংবাদিকতা সাহিত্যকে বস্তুনিষ্ঠ করে তোলে। তাই সংবাদপত্রের খবর ও খবরভাষ্য এখন আর শুধু খবর নয়, তা এখন সাহিত্যের রসমিশ্রিত সংবাদ-সাহিত্য। আর সাহিত্যও সব সময় কেবল সাহিত্য নয়। তাতে পড়ে সমসাময়িকতা ও বস্তুনিষ্ঠার ছাপ।
বাংলাদেশের সাংবাদিকতা এদিক থেকে পিছিয়ে নেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলা সাংবাদিকতা উর্দু ও ফারসি ভাষার সামন্ততান্ত্রিক ও ধর্মীয় মোহ থেকে মুক্ত হয়ে নিজস্ব ভাষাভিত্তিক আধুনিকতার পথে এগিয়ে যায়। স্বাধীনতার পর এই অগ্রযাত্রা দ্রুততর হয়। বাংলাদেশ প্রতিদিন তার সর্বাধুনিক উদাহরণ। পুরনো প্রজন্মের পাঠক এবং নতুন প্রজন্মের পাঠকের মধ্যে সেতুবন্ধের কাজ করছে পত্রিকাটি।
বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকাটির জন্মলাভের সময়টি একটি বিশেষ কারণে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এই সময় বাংলাদেশ এক-এগারোর সেনা তাঁবেদার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুঃসহ শাসনের অবসান ঘটিয়ে মাত্র বছরখানেক হয় গণতন্ত্রের পথে নতুন যাত্রা শুরু করেছে। নাজুক গণতন্ত্রের কণ্ঠকে আরও সোচ্চার করার জন্য একটি নতুন দৈনিক দরকার ছিল, যে দৈনিকটি গণতন্ত্র ও গণমানুষের স্বার্থের জন্য অন্তত সাহসী সৈনিক হওয়ার প্রয়াস চালাবে।
দেশে তখন অনেক দৈনিক। আর এসব দৈনিকের মধ্যে দিনবদলের ঘণ্টি বাজিয়ে ও নিরপেক্ষতার ছদ্মবেশ ধারণ করে যে পত্রিকাটি বাজার জাঁকিয়ে বসেছিল, তার ভূমিকা ছিল হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো। কোনো অন্ধকার অতল নদীগর্ভের দিকে সে জাতির একটা বড় মোহান্ধ তরুণ অংশকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, তার হদিস কেউ পাচ্ছিল না। তাকে রোখারও কোনো উপায় ছিল না। চালাকির সাংবাদিকতায় এই ‘নিরপেক্ষ’ দৈনিকটি তখন আর সব প্রতিযোগীকে টেক্কা মারছিল। বাংলাদেশ প্রতিদিন ওই দৈনিকটির অন্ধকার যাত্রাকে রুখে দিয়েছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নব্য পুঁজির অবাধ বিকাশ লাভের মুখে সৎ ও শুভ সাংবাদিকতার পাশাপাশি একটি অপসাংবাদিকতার বলয়ও তৈরি হতে থাকে। সে কথা আগেই বলেছি। সুবিধাবাদী একটি সাংবাদিক গোষ্ঠীও তৈরি হয়। তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি থেকে এই যুদ্ধের মৌলিক আদর্শ সম্পর্কেও জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। দেশে বারবার গণতন্ত্রের বিপর্যয় ঘটার মূলে তাদের ‘অবদান’ কম নয়। একসময় মনে হয়েছিল আদর্শবাদের বদলে শুধু বাণিজ্যিক মুনাফা ও সততা ও নিরপেক্ষতার বদলে স্বার্থবুদ্ধিজনিত পক্ষপাত ও বিভ্রান্তি সৃষ্টিই বুঝি শুভ ও সৎ সাংবাদিকতার শক্তিকে পরাস্ত করে ফেলবে। সুখের কথা, সেটা ঘটেনি। বাংলাদেশের সব স্তরের মানুষের মনে কোথায় যেন একটা অদৃশ্য প্রাণশক্তি এসেছে, যা বারবার শুভবুদ্ধির কাছে অশুভ শক্তির পরাজয় ঘটায়।
বাংলাদেশের রাজনীতির মতো তার সাহিত্য-সাংবাদিকতায়ও এটা ঘটতে দেখা গেছে। অশুভ শক্তি প্রবল বিক্রমে মাথা তুলেছে। মনে হয়েছে আমাদের সব শুভবুদ্ধি বুঝি পরাস্ত হতে চলেছে। তা হয়নি। নির্বাণমুখী মোমবাতির আলো থেকে সমগ্র মোমের আলো জ্বলে উঠেছে। অন্ধকারকে পরাস্ত হতে হয়েছে। সে অন্ধকার সাম্প্রদায়িকতার হোক, ধর্মান্ধতার হোক কিংবা সামরিক অথবা স্বৈরাচারী শক্তির হোক। আমজনতা মাথা তুলেছে। নূর হোসেনের মতো যুবক গুলির মুখে দাঁড়িয়ে গণতন্ত্রকে নিপাত হতে দেয়নি।
বাংলাদেশ প্রতিদিন দেশ ও জাতির দুঃসময়ে সাংবাদিকতায় তথাকথিত নিরপেক্ষতার মুখোশ ধারণ করেনি। বরং পক্ষপাত দেখিয়েছে, সে পক্ষপাত মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক আদর্শের প্রতি। বাংলাদেশ প্রতিদিন সংবাদ পরিবেশনে নিরপেক্ষ। কিন্তু মতামত প্রকাশে সে সৎ সাংবাদিকতার অবস্থান থেকে নড়তে চায়নি-এটা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট।
সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা অনেকটা আগুনের মতো। যা দিয়ে ঘর পোড়ানো যায়, আবার ঘরে ঘরে আলো বিতরণ করা যায়। নির্বাক, নির্যাতিত মানুষের কণ্ঠস্বরও সংবাদপত্র। বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার যুগপূর্তির এই শুভ দিনে এ কথা বলতে দ্বিধাবোধ করছি না যে, পত্রিকাটি ঘরে ঘরে আলো বিতরণ করেছে। কারও ঘর পোড়ায়নি। সব অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সে মানুষের কণ্ঠে সাহস ও শক্তি জুগিয়েছে। নির্বাক থাকেনি।
ঢাকা থেকে প্রথম বাংলা দৈনিক কাগজ বের হয় দৈনিক জিন্দেগি। ক্রাউন সাইজের চার পৃষ্ঠার কাগজ। এরপর মওলানা আকরম খাঁর দৈনিক আজাদ কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। কলকাতায় মুসলিম লীগের হাশেম-সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের সমর্থক আরেকটি দৈনিক ছিল ইত্তেহাদ। পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের নাজিমুদ্দীন গ্রুপ সেই কাগজটিকে ঢাকায় আসতে না দেওয়ায় তা বন্ধ হয়ে যায়।
প্রথমে ঢাকায় কোনো সরকারবিরোধী দৈনিক ছিল না। ফরিয়াদ, সৈনিক নামে ছোটখাটো সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিল। সদ্য প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের উদ্যোগে ইত্তেফাক সাপ্তাহিক হিসেবে বের হয়। লিয়াকত আলী খান যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তখন দেশের খসড়া সংবিধান প্রকাশ করা হয়। এই সংবিধানের মূলনীতিগুলো নিয়ে যে প্রতিবেদন বের হয় (মূলনীতি কমিটির প্রতিবেদন নামে পরিচিত), তাতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি যে অবজ্ঞা ও অবহেলা দেখানো হয়, যে বৈষম্যনীতি ধরা পড়ে, তাতে সারা প্রদেশে জনবিক্ষোভ শুরু হয়। এ সময় এই জনবিক্ষোভের মুখপত্র হিসেবে বংশাল রোডের বলিয়াদি প্রিন্টিং প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় দৈনিক ইনসাফ। যদিও ছোট কাগজ; কিন্তু সরকারের বিরোধিতার জন্য যথেষ্ট জনপ্রিয় দৈনিক হয়ে উঠেছিল।
পাকিস্তান আমলে তারপর একে একে বের হয় দৈনিক সংবাদ, দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক মিল্লাত। ওই আমলের ইংরেজি দৈনিক মর্নিং নিউজ ও পাকিস্তান অবজারভার। বাংলা দৈনিক পাকিস্তান যদিও সরকারি প্রেস ট্রাস্টের কাগজ ছিল; কিন্তু তখনকার বহু তরুণ প্রগতিশীল কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক এই কাগজে কাজ করায় তা তরুণ প্রজন্মের পাঠকদের কাছে একটি জনপ্রিয় পত্রিকা হয়ে উঠেছিল।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতীয় সংবাদপত্রের চরিত্র-পরিবর্তন ঘটে। দৈনিক ইত্তেফাক প্রথম বাংলাদেশে মতামত-প্রধান সাংবাদিকতা প্রবর্তন করে। দেশের জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক ধারার সংবাদপত্র ইত্তেফাক। বাম গণতান্ত্রিক ধারার সংবাদপত্র সংবাদ। তখন সংবাদপত্রশিল্পের মালিকানাও ছিল রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক নেতাদের হাতে। স্বাধীনতার পর সংবাদপত্রের এই চরিত্র বদলে যায়। রাজনীতিকদের বদলে নব্য ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের হাতে সংবাদপত্রের কর্তৃত্ব চলে যায়। রাজনৈতিক সাংবাদিকতার বদলে বাণিজ্যিক বা কমার্শিয়াল সাংবাদিকতা প্রাধান্য বিস্তার করে।
পাকিস্তান আমলে দৈনিক ইত্তেফাক মতামত-প্রধান সাংবাদিকতা এবং কলকাতার বাবুভাষার বদলে সাংবাদিকতায় জনভাষা ব্যবহার শুরু করলেও প্রথাগত সাংবাদিকতা পরিত্যাগ করেনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাংবাদিকতার এই প্রথাগত চরিত্র বদলে যায়। সাহিত্য ও সাংবাদিকতার মধ্যে মেলবন্ধন ঘটে। সংবাদপত্রের চেহারা ও আঙ্গিক সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। শুধু রাজনৈতিক খবর নয়, শিক্ষা, শিল্প, বাণিজ্য, ক্রীড়া এমনকি পাঠকের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন নিয়েও ফিচারের সংখ্যা বেড়ে যায়। যে ঢাকায় ১৯৪৭ সালে বাংলাভাগের আগে একটিও দৈনিক সংবাদপত্র ছিল না, সেখানে আজ অগণিত দৈনিক সংবাদপত্র। বিশ্বের যে কোনো উন্নত দেশের উন্নত সংবাদপত্রের সঙ্গে ঢাকার সংবাদপত্র এখন চেহারায়, গুণে-মানে টেক্কা দিতে পারে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন তেমনই নতুন প্রজন্মের দৈনিক। আমার কাছে এই কাগজের বড় আকর্ষণ, কাগজটির নিজস্ব মতামত আছে। আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণে অবিচল নিষ্ঠা। খবর ও খবরভাষ্য প্রচারে সাহিত্যরসের মিশ্রণ। কাগজটি যুগের চাহিদা পূরণ করে নতুন সম্ভাবনা দেখিয়েছে। আজ বাংলাদেশ প্রতিদিন যুগপূর্তি করছে। পত্রিকাটি যুগ যুগ পাঠকপ্রিয় থাকবে-এটা আমার বিশ্বাস।
বিডি-প্রতিদিন/শফিক