ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার নামে ৫০০ কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ পাওয়া একটি রাষ্ট্রীয় প্রকল্পে কাজ হয়েছে মাত্র ২ শতাংশ। অথচ প্রকল্প কার্যক্রম স্থগিত হওয়ার আগেই অনুমোদনের বাইরে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২৮ কোটি টাকা। কে এই অতিরিক্ত ব্যয়ের অনুমতি দিল, কোন চুক্তির ভিত্তিতে এত বড় কাজ হয়েছে—প্রকল্প কাগজপত্রে তার কোনো জবাব নেই। এভাবে পুরো প্রকল্পে হয়েছে রাষ্ট্রীয় অর্থের ব্যাপক লুটপাট।
পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। ‘শেখ হাসিনা স্পেশালাইজড জুট টেক্সটাইল মিল (প্রথম সংশোধিত সমাপ্তীকরণ)’ প্রকল্পটি এখন প্রশ্নবিদ্ধ ‘প্রকল্প সমাপ্তির’ প্রস্তাব হিসেবে পরিকল্পনা কমিশনে রয়েছে। প্রকল্পের মূল এলাকা জামালপুর হলেও সংশোধিত প্রস্তাবে ব্যয় দেখানো হয়েছে ঢাকার লতিফ বাওয়ানী জুট মিলস এলাকায়।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা যায়, মূল প্রকল্পটি ৫১৮ কোটি টাকার হলেও মিল বন্ধ ঘোষণা ও কার্যক্রম স্থগিত হওয়ার পর প্রকল্পটি সমাপ্ত করতে ৩৯.৮২ কোটি টাকার সংশোধিত প্রস্তাব পাঠানো হয়।
অথচ প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ২.১১% এবং আর্থিক অগ্রগতি ৭%। এর পরও প্রায় ৩০ কোটি টাকা ব্যয় কিভাবে কার অনুমতিতে ও কী পরিমাণ কাজের জন্য হলো, তা নিয়ে সভায় প্রশ্ন উঠেছে।
২৮ কোটি টাকার অতিরিক্ত জমি উন্নয়নকাজ : পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের আগেই প্রকল্পে ৩৪ একর জমিতে পাঁচ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার মাটি উন্নয়নের কাজ সম্পন্ন হয়। অথচ প্রকল্প অনুমোদন অনুযায়ী জমি উন্নয়নের বরাদ্দ ছিল মাত্র ছয় কোটি ১৮ লাখ টাকা এবং অনুমোদিত কাজ ছিল ৮৫ হাজার ৬৪১ ঘনমিটার।
বাস্তবে কাজ হয়েছে অনুমোদনের প্রায় ছয় গুণ বেশি, যার মূল্য ৩৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। ফলে অনুমোদনের বাইরে ২৮ কোটি ২৮ লাখ টাকার কাজ হয়েছে, যা প্রকল্পের বাইরে অতিরিক্ত ব্যয় হিসেবে বিবেচিত। এ কাজে কোনো চুক্তিপত্র ছিল না।
সভায় জানানো হয়, চুক্তির অতিরিক্ত কাজের জন্য কোনো কার্যাদেশ দেওয়া হয়নি। এটি প্রকল্প পরিচালনার চরম অব্যবস্থাপনার দৃষ্টান্ত।
প্রকল্প জামালপুরে, খরচ বাওয়ানীতে : জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদিত প্রকল্প এলাকা ছিল জামালপুর। কিন্তু সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (আরডিপিপি) প্রকল্প এলাকা হিসেবে দেখানো হয়েছে বিজেএমসি নিয়ন্ত্রিত লতিফ বাওয়ানী জুট মিলস। শুধু তা-ই নয়, এই বিভ্রান্তিকর তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই ভূমি উন্নয়ন ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে। পিইসি সভায় কর্মকর্তারা বলেন, এটি প্রকল্প পরিচালনার দায়িত্বহীনতার জ্বলন্ত উদাহরণ।
অগ্রগতি ২.১১%, তবু ৩৯ কোটি টাকার প্রস্তাব : মূল প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি, তা স্বীকার করেই ‘সমাপ্তির’ প্রস্তাব আনা হয়েছে। কিন্তু আরডিপিপি তথ্য অনুযায়ী, প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ২.১১%, আর্থিক অগ্রগতি ৭%। তবু শেষ আরডিপিপিতে ৩৯ কোটি ৮২ লাখ টাকার ব্যয় দেখানো হয়েছে, যা আগের প্রস্তাবের (১০.৮৪ কোটি) তুলনায় তিন গুণের বেশি। এই ব্যয়বৈচিত্র্য নিয়েও কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নেই।
গাফিলতি, বিলম্ব, অস্বচ্ছতা—দায় কার : প্রকল্পটির কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত হয় ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে। অথচ আরডিপিপি পাঠানো হয় দুই বছর সাড়ে তিন মাস পরে, ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে। এই বিলম্বের কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা আরডিপিপিতে নেই। আবার ২০২৩ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত বারবার আরডিপিপি পাঠানো হলেও ব্যয়ভিত্তিক তারতম্য সম্পর্কে কোনো স্বচ্ছতা রাখা হয়নি।
পিইসি সভায় একাধিকবার মন্ত্রণালয় ও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বিজেএমসির সমন্বয়হীনতা ও গাফিলতির কথা উঠে আসে। অতিরিক্ত কাজ, যাচাইবিহীন বাস্তবায়ন এবং অনুমোদনের বাইরে ব্যয়ের দায় কার—এই প্রশ্নের জবাব আরডিপিপিতে নেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে এত বড় ব্যয়ের তারতম্য, নথিপত্রের অসংগতি এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে দায়িত্বহীনতা প্রকল্পটি ‘সমাপ্তি’র নামে একটি আর্থিক জটিলতায় পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন জাগে, অনুমোদনের বাইরে ব্যয় হওয়া এই ২৯ কোটি টাকার প্রকৃত প্রাপক কারা? এই টাকা কি সরকারি খাতে ব্যবহৃত হয়েছে, নাকি গায়েব হয়ে গেছে কিছু প্রভাবশালীর পকেটে?
প্রকল্পটিতে অনিয়মের বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. তোফাজ্জল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, এই প্রকল্পে যে কাজ হয়েছে, তা ২০২০ সালেই হয়েছে।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে আরডিপিপিতে ১০ কোটি ৮৫ লাখ টাকায় শেষ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এখন কিভাবে ৩৯ কোটি টাকা হলো—এমন প্রশ্নে কোনো উত্তর দেননি প্রকল্প পরিচালক। এ বিষয়ে বিজেএমসি চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রকল্প পরিচালকই এ বিষয়ে জানাবেন বলে জানান।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে যেভাবে অনুমোদনের বাইরে কাজ হয়েছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সরকারি অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকা উচিত, তা এখানে নেই। প্রকল্প এলাকায় বিভ্রান্তি, চুক্তিবিহীন অতিরিক্ত কাজ ও দীর্ঘসূত্রতা—সব কিছুই প্রমাণ করে পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও তদারকিতে দুর্বলতা রয়েছে। প্রকল্পটি একটি ‘বিলম্বিত সমাপ্তি’ নয়, বরং এটি জনগণের অর্থের অপচয় এবং প্রশাসনিক সমন্বয়হীনতার একটি জটিল উদাহরণ। এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সংস্কার না হলে উন্নয়ন ব্যয়ই হবে ভবিষ্যতের দায়।
সূত্র : কালের কণ্ঠ