গত বৃহস্পতিবার ব্রিটেনের প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের অনলাইন সংস্করণে বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানের ১১ মাসের মূল্যায়ন নিয়ে ‘বিপ্লবের পর বাংলাদেশের একটি বড় ভুল : প্রতিশোধ সংস্কারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনটির চৌম্বক অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো :
শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটানো গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর হয়ে গেল। কয়েক সপ্তাহের এই আন্দোলনে এক হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন; আহত হয়েছেন আরো অনেক। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর শান্তিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়।
এই সরকার দেশে শৃঙ্খলা ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। বছরের পর বছর ধরে অব্যবস্থাপনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তারা পুনর্গঠিত করারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
১১ মাস পর দেখা যাচ্ছে কাজটা বেশ কঠিন। রাজনৈতিক মিছিল-সমাবেশ এখনো চলছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যে কাটছাঁট ও পণ্যে শুল্ক বসানো দেশের উন্নয়নকে হুমকির মুখে ফেলেছে। সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী ও গুরুত্বপূর্ণ দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এখন সংকটে। ইকনোমিস্ট প্রশ্ন তুলেছে, বাংলাদেশ কী নতুন সূচনার সুযোগকে হাতছাড়া করে ফেলছে?
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস অবশ্য বলছেন, তাঁর পরিকল্পনা সঠিক পথেই এগোচ্ছে। দ্য ইকোনমিস্টকে দেওয়া সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে ৮৪ বছর বয়সী ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ যেসব গভীর সংস্কার চায়, সেগুলো বাস্তবায়নে সময় লাগবে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ধারণা করছে, শেষ হতে চলা ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৪.২ শতাংশ থেকে কমে ৩.৯ শতাংশ হবে। এটি কম হলেও গত বছর যেটা আশঙ্কা করা হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক ভালো। প্রবাস আয় বেড়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে এবং বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি গত বছরের জুলাইয়ে ১২ শতাংশ থাকলেও এবার মে মাসে ৯ শতাংশে নেমে এসেছে। সরকার ব্যাংকিং খাতে জমে থাকা খেলাপি ঋণ দূর করার চেষ্টা করছে এবং আগের সরকারের আমলে বিদেশে পাচার হওয়া শত শত কোটি ডলারের খোঁজে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে।
অর্থনীতির সংস্কার বিদেশে যতটা বাহবা কুড়িয়েছে, ততটাই প্রশ্ন উঠেছে সরকারের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে।
ডক্টর ইউনূস বলছেন, ‘বাংলাদেশ সব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায়।’ কিন্তু মার্চে তিনি চীন সফরে গিয়ে কয়েকটি চুক্তি সই করেন। এসব পদক্ষেপ ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল ধরাচ্ছে। বাংলাদেশিরা অবশ্য এ নিয়ে খুব একটা ভাবছে না। গত বছরের এক জরিপে দেখা গেছে, ৭৫ শতাংশ মানুষ চীনকে পছন্দ করে। অন্যদিকে ভারতকে পছন্দ করে মাত্র ১১ শতাংশ মানুষ।
তবে বাংলাদেশের সামনে এখনো সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, গণতন্ত্র কত দ্রুত ফিরবে এবং এই অর্জন কতটা স্থায়ী হবে। অধ্যাপক ইউনূস ইঙ্গিত দিয়েছেন, নির্বাচন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে হতে পারে অথবা অন্তত এপ্রিলের মধ্যে। এর আগে তিনি চান, সব রাজনীতিক ‘জুলাই সনদ’ নামে একটি নীতিগত ঘোষণাপত্রে সই করুন। এই সনদে নির্বাচনের নিয়ম ও নির্বাচিত সরকারের জন্য সংস্কারের রূপরেখা থাকবে।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বলেছে, সরকার ‘নির্বিচারে’ আওয়ামী সমর্থকদের নিশানায় পরিণত করছে, যেমনটা আগের সরকারের সময় বিরোধী সমর্থকদের ওপর করা হতো।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের আইন বিশেষজ্ঞ আরাফাত খান বলছিলেন, স্থায়ী পরিবর্তন আনতে হলে প্রতিশোধ নয়, পুরো জাতিকে এক করতে হবে—এই মূলনীতি দরকার। বাংলাদেশের এখন দরকার একটি ‘নেলসন ম্যান্ডেলা মুহূর্ত’।
একই তারিখে সাময়িকীটিতে ‘বিরোধী দলকে নিষিদ্ধ করা বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবিত করার কোনো উপায় নয়’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ স্বাধীনভাবে প্রচারণা চালালেও হয়তো জয়ী হবে না। তবে সংসদে তাদের উপস্থিতি বিরোধী শিবিরকে শক্তিশালী করতে পারে, যা বিজয়ীদের সতর্ক রাখবে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য প্রতিশোধ নয়, প্রয়োজন পুনর্মিলন।