মদিনার ইহুদি গোত্র বনু জুরাইজের মিত্র লাবিদ বিন আসেম নামের একজন মুনাফিক তার মেয়েকে দিয়ে মহানবী (সা.)-এর মাথার ছিন্ন চুল ও চিরুনির দাঁত চুরি করে এনে তাতে জাদু করে এবং মন্ত্র পাঠ করে চুলে ১১টি গিরা দেয়। এর প্রভাবে মহানবী (সা.) কোনো কাজ করলে ভুলে যেতেন এবং ভাবতেন যে করেননি। প্রায় ৪০ দিন বা ছয় মাস এভাবে থাকে।
এক রাতে মহানবী (সা.) স্বপ্নে দেখেন—দুজন লোক এসে একজন তাঁর মাথার কাছে, অন্যজন পায়ের কাছে বসে।
অতঃপর তারা বলে যে বনু জুরায়েকের খেজুর বাগানে যারওয়ান কুয়ার তলদেশে পাথরের নিচে চাপা দেওয়া খেজুরের কাঁদির শুকনা খোসার মধ্যে ওই জাদু করা চুল ও চিরুনির দাঁত আছে। ওটা উঠিয়ে এনে গিরা খুলে ফেলতে হবে। সকালে তিনি আলী (রা.)-কে সেখানে পাঠান এবং যথারীতি তা উঠিয়ে আনা হয়। অতঃপর আল্লাহর রাসুল (সা.) গিরাগুলো খুলে ফেলেন এবং তিনি সুস্থ হয়ে যান। (বুখারি, হাদিস : ৫৭৬৫ ও ৬০৬৩)
এ সময় মহান আল্লাহ সুরা ফালাক ও নাস নাজিল করেন। যার ১১টি আয়াতের প্রতিটি পাঠের সঙ্গে সঙ্গে জাদুকৃত চুলের ১১টি গিরা পরপর খুলে যায় এবং আল্লাহর রাসুল (সা.) সুস্থ হয়ে যান।
মহানবী (সা.)-কে প্রতিশোধ নিতে বলা হলে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ আমাকে আরোগ্য দান করেছেন। আমি এ বিষয়টি অপছন্দ করি যে লোকদের মধ্যে মন্দ ছড়িয়ে পড়ুক।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৩৯১)
মহানবী (সা.)-কে জাদু করার উদ্দেশ্য
ইহুদি ও মুনাফিকরা চেয়েছিল মহানবী (সা.)-কে পাগল (নাউজুবিল্লাহ) বানাতে এবং তাঁর মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটাতে। তারা চেয়েছিল মহানবী (সা.)-এর দাওয়াতি কাজ বাধাগ্রস্ত করতে। তারা চেয়েছিল ইসলামের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিতে। এটা ছিল তাদের শত্রুতার নিকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত। কিন্তু মহান আল্লাহ তাঁর রাসুলকে হেফাজত করেছিলেন।
আর এভাবে প্রত্যেক মুমিনকে হেফাজত করা আল্লাহর কর্তব্য বলে তিনি ঘোষণা করেছেন। পবিত্র কোরআনে এসেছে— ‘অবশেষে আমি (আল্লাহ) আমার রাসুলদের আর মুমিনদের রক্ষা করি, এভাবে মুমিনদের রক্ষা করা আমার কর্তব্য।’ (সুরা : ইউনুস, আয়াত : ১০৩)
মহানবী (সা.)-এর ওপর জাদুর ক্রিয়া কার্যকর হওয়ার কারণ
প্রশ্ন হতে পারে যে মহানবী (সা.)-এর ওপর জাদুর ক্রিয়া কার্যকর হলো কেন? কেননা তিনি তো আল্লাহর রাসুল। এর জবাব এই যে আগুন ও পানির মতো জাদুরও একটি স্বাভাবিক ক্রিয়া আছে। নবীরা মানুষ ছিলেন। তাই তাঁরাও এসবের প্রতিক্রিয়ার ঊর্ধ্বে ছিলেন না। অর্থাৎ নবী-রাসুলরা দুনিয়ার আসবাব-উপকরণের ঊর্ধ্বে নন। তবে হ্যাঁ, জাদুর প্রতিক্রিয়ায় মহানবী (সা.)-এর ব্যাপক কোনো ক্ষতি হয়নি। জাদুর প্রভাবে তিনি কিঞ্চিৎ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আর এই ক্ষতি হওয়া বা না হওয়া আল্লাহর ইচ্ছাধীন বিষয়। যেমন—আল্লাহর হুকুমে আগুন ইবরাহিম (আ.)-এর কোনো ক্ষতি করেনি। আল্লাহ বলেন, ‘আমি বললাম, হে আগুন, তুমি শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও ইবরাহিমের জন্য’। (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৬৯)
ইউনুস (আ.)-কে নদীর পানি ও মাছ কোনো ক্ষতি করেনি। (সুরা : সাফফাত, আয়াত : ১৪০-১৪৫)
তেমনি আল্লাহর হুকুমে জাদুর ক্রিয়া রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আত্মিক ও জ্ঞানগত কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। ওহির প্রচার ও প্রসারেও কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি, যেটা শত্রুরা কামনা করেছিল। এমনকি তাঁর মস্তিষ্কেরও বিকৃতি ঘটেনি, বরং তাঁর মধ্যে ব্যক্তিগত জীবনে সাময়িক এক ধরনের স্মৃতিভ্রম তৈরি হয়েছিল, যা খুব দ্রুত সেরে যায়। আয়েশা (রা.) বলেন, জাদুর প্রতিক্রিয়ায় মহানবী (সা.)-এর এমন অবস্থা হয় যে তাঁর মনে হতো তিনি বিবিদের কাছে এসেছেন, অথচ তিনি আদৌ তাঁদের কাছে আসেননি। বর্ণনাকারী সুফিয়ান বলেন, এ অবস্থা জাদুর চরম প্রতিক্রিয়া। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৭৬৫)
কিন্তু মহান আল্লাহ আসমান থেকে ফেরেশতা পাঠিয়ে তাঁর প্রিয় হাবিবকে দ্রুত সুস্থ করে তোলেন।
বিডি প্রতিদিন/কেএ