চাঁদাবাজ কে বা কারা, এটা বোধহয় সমাজের ধনী-দরিদ্র, কৃষক-কৃষাণি, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, প্রশাসন (পুলিশ/সিভিল) সর্বোপরি সরকার সবাই জানেন। তবে চাঁদাদাতা কে এ ব্যাপারে আমরা কখনো গভীরভাবে চিন্তা করিনি। সমাজের সর্বস্তরে ছোট-বড় সবার কাছ থেকে আমৃত্যু শেখার অনেক কিছুই আছে। এটা হঠাৎ করে আমি আমার এক সহকারীর কাছ থেকে পুনরায় শিখলাম। সে বয়সে আমার মেয়ের চেয়েও অনেক ছোট। সদ্য গ্র্যাজুয়েশন লাভ করেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে, মেডিসিনের শিক্ষাগুরু Sir William Osler-এর সেই বিখ্যাত উক্তি ‘A doctor is a student till his death when he fails to be a student he dies.’অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের দিন দিন এত নতুন নতুন আবিষ্কার হচ্ছে, লেখাপড়া না চালিয়ে গেলে একদিন তুমি হারিয়ে শুধু যাবে না, চিকিৎসক হিসেবে মৃত্যু ঘটবে। শুধু ডাক্তারের বেলায়ই যে এ কথা প্রযোজ্য তা নয়, শেখার শেষ নেই- এটা সবার জন্য প্রযোজ্য।
প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুধু ডিগ্রি অর্জন বা জ্ঞান অর্জনের সূচনা বা মাধ্যম। যা মানুষকে পরবর্তীতে চর্চার মাধ্যমে জ্ঞানের পরিপক্বতা আনতে সহায়তা করে। আমাদের প্রিয় শিক্ষক মরহুম অধ্যাপক এম এ মান্নান স্যার সব সময়ই বলতেন, কোনো কাগজ ওয়ার্ডে পড়ে থাকতে দেখলে, হাতে নিয়ে পড়বে, দেখবে নতুন একটা কিছু শিখতে পারবে। এটা একটা অমোঘ সত্য বাণী।
ষাটের দশকে আমরা যখন স্কুলে পড়ি, তখন মাওলানা ইসমাইল হোসেন শীতকালে গ্রামেগঞ্জে মাহফিল করতেন। আমরা তখন ধানক্ষেতের মাঠে নানা ধরনের খেলাধুলা করতাম। আমার দাদু ডা. অশ্বিনী কুমার দত্ত, তার হাতের বেতের লাঠিটা নিয়ে তাড়া করে বলতেন, মাওলানা সাহেবের ওয়াজ শুনতে। তবে তিনি যে উচ্চশিক্ষিত ভদ্রলোক ছিলেন এবং ইংরেজি ও বাংলায় সমান দক্ষ ছিলেন, তা তার বয়ান থেকে বোঝা যেত। তার বয়ান এবং বর্তমানে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বয়ানের মধ্যে প্রচুর পার্থক্য। সাঈদী যে রকম সুড়সুড়ি দেওয়া, কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দেন, তার মধ্যে তা ছিল না। তার একটা কথা আমি এখনো পালনের চেষ্টা করি ডাক্তার হিসেবে, যা হলো- 'তোমার প্রতিবেশীর, তোমার ওপর সব রকমের দাবি আছে, গরিব হলে তোমার জাকাতের অংশীদার, চিকিৎসক হলে রোগের চিকিৎসার, কৃষক হলে তোমার জমি চাষ করার।'
যদি অর্ধেক পারিশ্রমিকে তুমি দূর-দূরান্ত থেকে কাজের লোক আনতে পার, তাহলেও আনবে না। বরং তোমার প্রতিবেশীকে কাজ করার সুযোগ দাও। দেখবে অনেক লাভ হবে উভয়ের। আমি তার চিকিৎসা সংক্রান্ত কথাটা মেনে চলার চেষ্টা করি। যে কেউ, পরিচিত কিংবা অপরিচিত যদি এসে বলেন, চান্দিনা থেকে এসেছি, তাদের ফিস ছাড়া দেখার চেষ্টা করি। তবে মজার ব্যাপার হলো, এখন আশপাশের সব উপজেলার লোকদের অনেকেই এসে বলেন চান্দিনা থেকে এসেছি। তাতেও আমার খারাপ লাগে না বা দুঃখবোধ হয় না। সময় পেলে দেখে দেওয়ার চেষ্টা করি।
কে চাঁদা দেয়, এটা যার কাছ থেকে শিখলাম- আমার সহকারী চিকিৎসককে জিজ্ঞাসা করলাম, তার বন্ধুর বাবার মিষ্টি দোকান থেকে কাউকে চাঁদা দিতে হয় কি না? সে বলল সবাইকে দিতে হয় দল-মত, পাড়া-পড়শি, ক্লাব-সমিতি এমন কি সদ্য গজিয়ে ওঠা মাস্তান পর্যন্ত। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তাহলে ব্যবসা হয় কী করে? লাভ কি করেন? ইত্যাদি। সে উত্তর দিল চাঁদা তো মালিক দেয় না। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম তাহলে কে দেন? তার জবাব সব মিষ্টি ক্রেতা। আবারও জিজ্ঞাসা করলাম কেমন করে? তার স্বভাবসুলভ জবাব হলো রসমালাই এখন যে দামে বিক্রি হচ্ছে, তার অর্ধেক দামে বিক্রি করা সম্ভব। ডাবল দামে বিক্রি করে আমাদের কাছ থেকে যে অতিরিক্ত টাকাটা পান, তা-ই তিনি চাঁদা হিসেবে দিয়ে থাকেন, বরং চাঁদা না দিলে লাভ আরও কম হতো।
সরকারের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বললেন, ঢাকা শহরের অনেক মসজিদ কমিটির চেয়ারম্যান বা সভাপতি নিয়োগে যে তদবির চলে তা অকল্পনীয়। মসজিদ বা মুসলি্লদের সেবার জন্য নয়। বরং মসজিদ কমপ্লেক্সে অনেক দোকান থাকে তা থেকে উপরি আয় হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মন্দির কমপ্লেঙ্ যেখানে দোকানপাট আছে, সে ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এক সময়ের ঢাকা শহরের অতি পরিচিত মিষ্টির দোকান 'আলাউদ্দীন সুইটস' একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল তাও শুধু চাঁদার টাকার চাহিদা মেটাতে গিয়ে। অনেকে হয়তো এটা স্বীকার করবেন না, কিন্তু এটা অপ্রিয় সত্য। কৃষকদের উৎপাদিত সবজি জাতীয় পণ্য যদি জমিন থেকে বিভাগীয় ও রাজধানী পর্যায়ের বাজারে আসতে চাঁদার শিকার না হতো তাহলে বেতন বাড়ানোর প্রয়োজন হতো কি-না এটাও প্রশ্নের ব্যাপার।
আমার বিশ্বাস, সমাজের সর্বক্ষেত্রে চাঁদাবাজদের যে দৌরাত্দ্য সেটা নিয়ন্ত্রণে আনা গেলে ঢাকা শহরসহ পুরো দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম অনেক কমে আসবে। নাগরিক জীবন সুন্দর ও স্বাচ্ছন্দ্য হবে। মানুষকে বাড়তি আয়ের জন্য ছুটতে হবে না। এমনি করেই ঘুষ ও দুর্নীতিও অনেকাংশে কমে যাবে। সময় এসেছে প্রত্যেক পেশাজীবীকে শপথ নেওয়ার- আমরা দুর্নীতি করব না। বিশেষ করে সিভিল প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, চিকিৎসক (স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী) এবং শিক্ষক, যারা প্রকৃত শিক্ষা দিয়ে, শিক্ষিত যুবসমাজ গড়ে জাতির মেরুদণ্ড সুদৃঢ় করে তুলবেন।
লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।