ক্ষমতাসীন জোটের শীর্ষ নেত্রী দাম্ভিকতার পাদপীঠে অনড় এবং অটল ছিলেন। অন্যদিকে ২০-দলীয় জোটের শীর্ষ নেত্রী শুধু জেদই নয় প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে গিয়ে ৯২ দিন টানা অবরোধ ও হরতালের মধ্যে দেশের অর্থনীতিকে শুধু ভঙ্গুরই নয়, একটি অনিবার্য ধ্বংসের শেষ প্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছেন। জাতিসংঘ এবং দেশি-বিদেশি সুশীল সমাজ এ পরিস্থিতির অবসান চাইলেও রাজনৈতিকভাবে রাষ্ট্রীয় অঙ্গনে দুই জোট ব্যতিরেকে অন্যদের অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল বলে দুই জোটেরই শীর্ষ নেতৃদ্বয় এ বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া তো দূরে থাক বিন্দুমাত্রও বিবেচনার আঙ্গিকে আনার কোনো প্রয়োজন বোধ করেননি। দেশ ও মানুষের প্রতি তাদের অবহেলা ও ঔদাসীন্য এতটাই প্রবল হয়ে প্রতিভাত হচ্ছিল যে- দেশবাসীর মতো আমিও প্রায় নিশ্চিত ছিলাম দেশটি সোমালিয়া হলেও কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেবেন না, সমঝোতা তো কল্পনারই আবর্তের বাইরে। একটা অনিশ্চয়তা আর সংশয়-দ্বিধাদ্বন্দ্বের অতল গভীরে ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছিল গণতান্ত্রিক অবকাঠামো তো বটেই, তার ন্যূনতম সহনশীলতাও।
শুধু '৭১ সালে স্বাধীনতার পর নয়, পাকিস্তান আমলেও এরকম দুর্বিষহ রাজনৈতিক সংকট, সংশয় ও অনিশ্চয়তা আসেনি। একদিকে হরতাল-অবরোধ, অন্যদিকে প্রশাসনের নির্যাতন, নিগ্রহ (গুম, খুন) নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। এই পরিস্থিতিকে অকুতোভয়ে যারা চ্যালেঞ্জ করতেন- দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে তাদের কণ্ঠও ক্রমেই ম্রিয়মাণ হয়ে আসছিল। যেহেতু ওই দুই জোট ব্যতিরেকে তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক শক্তির অবস্থানকে সুদৃঢ় করা তো দূরে থাক, স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক চর্চার ন্যূনতম সহনশীলতাও দেখানো হচ্ছিল না, তখন তারাও ব্যথিত চিত্তে, মর্মাহত হৃদয়ে নীরব, নিথর, নিস্পৃহ না হলেও দৃশ্যত ম্রিয়মাণ হয়ে গিয়েছিলেন। রাজনৈতিক গভীর বিশ্লেষণ এবং জটিলতার গভীরে না গিয়েও বলা যায়, যে দেশে সভা-সমিতি ও মিছিলের বজ্র নির্ঘোষিত আওয়াজ উচ্চারিত হয় না- সেখানে গণতন্ত্রের চর্চা আছে, অনুশীলন আছে এটা বলা যায় না। বরং গণতন্ত্রের কোনো সংজ্ঞাতেই সে দেশকে চিহ্নিত করা যায় না। দুটি জোটকে যেহেতু দেশের মানুষ একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ ভাবে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা অথবা ক্ষমতার মসনদ দখল করা ছাড়া রাজনীতিতে অন্য কোনো জনস্বার্থ-বিষয়ক কর্মসূচি না হওয়ায় এই দুঃসহনীয় অবস্থাটাও মানুষের কাছে অনেকটা গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল।
আল্লাহর অশেষ রহমতে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ঘোষণা আসায় জনতার হৃদয়ে ঘনঘোর অমানিশা কিছুটা হলেও কাটতে শুরু করেছে। এই নির্বাচনটিকে অর্থবহ, নিরপেক্ষ এবং সর্বজনগ্রাহ্য করার মুখ্য দায়িত্ব সরকারের এবং এটা সম্ভব করতে পারলে তারা যে কতখানি লাভবান হবেন, জয়-পরাজয় যাই হোক, সেটি অনুধাবন করা এবং এই বাস্তব সত্য উপলব্ধি করার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা তাদের আছে বলেই আমি এখনো বিশ্বাস করি। দুটি বিষয়ে আমি শতভাগ নিশ্চিত- ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক হিসেবে প্রত্যক্ষভাবে কিছুটা হলেও স্বীকৃতি পাবে। অন্যদিকে জয়-পরাজয় যাই হোক এ সরকার একটি সফল, সক্রিয়, অর্থবহ ও হস্তক্ষেপ-বিবর্জিত নির্বাচন করার মানসিকতা রাখেন এটা অবশ্যই প্রতিভাত হবে। যদিও বাংলাদেশে প্রশাসন- বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন এমনকি বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতার বিষয়ে জনগণের আস্থার স্থানটি অত্যন্ত দুর্বল।
সব দলের প্রার্থীরাই বিজয়ের প্রত্যাশা নিয়েই নির্বাচন করে এটা স্বাভাবিক এবং চিরন্তন। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে মধ্য পর্যায়ের কোনো নেতা যদি বলেন, যে কোনোভাবে আমরা নির্বাচনে জয়লাভ করবই- অন্যদের শঙ্কিত হওয়াই স্বাভাবিক এবং নির্বাচনের স্বচ্ছতার ব্যাপারেও তারা প্রশ্ন তুলতে পারেন। কাজেই এ বিষয়টি সম্পর্কে সরকারদলীয় জোটকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। সিটি নির্বাচনকে সামনে রেখে অলৌকিকভাবে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর সুযোগ সরকারের নেই। সে ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন শীর্ষ নেতৃত্বকে স্বচ্ছ, আন্তরিকতায় প্রত্যয় দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে হবে- এ নির্বাচনটি শুধু অনুষ্ঠিতই নয়, তার নিরপেক্ষ মানসিকতাকে এই প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও প্রতিভাত করতে হবে। এতে সমাজের অস্বস্তি অনেকটা দূর হবে মানুষের অনিশ্চয়তা ও অন্ধকার ধীরে ধীরে কেটে যাবে এবং স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছানোর পাদপীঠ তৈরি হবে।
যারা ঘোরতর দলকানা, তারা স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন তুলতে পারেন- এই ৯২ দিনের একটানা অবরোধ, হরতাল, সন্ত্রাস, বোমাবাজি, এত নিষ্পাপ প্রাণের অবসান, এত অশ্রু, এত আর্তনাদ, এত হাহাকার- তা কি সবই বেমালুম বিস্মৃত হতে হবে? এর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপই কি নেওয়া যাবে না? অন্যদিকে ২০-দলীয় জোটের তরফ থেকেও প্রশ্ন আসতে পারে- এই নির্যাতন, নিষ্পেষণ, জেল-জুলুম, খুন-গুম এগুলো আমরা বেমালুম হজম করব কেন? এটি উভয়ের কাছেই পরিস্থিতির দাবি। উভয় পক্ষই বিষয়গুলো বেমালুম বিস্মৃত না হয়ে, উভয়ের প্রশ্নগুলোই আইনের নিরপেক্ষ হাতে তুলে দিয়ে আসন্ন নির্বাচনটিকে সফল করতে পারলে পরিস্থিতিটা এমনিতেই স্বাভাবিকতার দিকে মোড় নেবে। প্রাসঙ্গিকভাবে আমি আবারও দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই- ক্ষমতাসীন শীর্ষ নেতৃত্ব ধৈর্য-সহনশীলতার অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি। ৯২ দিনের অবরোধ-হরতাল, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ দেশের সমগ্র মানুষ অবহিত। এ সত্যটি তার মানসিকতায় থাকতে হবে। এটা অতিকথায় ব্যঙ্গোক্তির মাধ্যমে উচ্চারণ করা এবং বারবার কটাক্ষ করা, সৃষ্ট সুযোগের সদ্ব্যবহারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। বরং চরম সহিষ্ণুতার সঙ্গে আসন্ন পরিস্থিতিতে জয়-পরাজয়ের কথা না ভেবে তাকে হৃদয়ের ঔদার্য নিয়ে এগোতে হবে। দিল্লিতে সম্প্রতি কেজরিওয়ালের বিজয়ে বিজেপির মতো কট্টর ধর্মভিত্তিক দলের সহনশীলতা তার জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে। সামগ্রিকভাবে ভারতের জাতীয় নির্বাচন তো বটেই, তদুপরি দিল্লির মসনদ হাতছাড়া হওয়ার পরও বিজেপির মতো দলের সহনশীলতা থেকে শিক্ষা নেওয়া বাংলাদেশের উভয় জোটেরই শীর্ষ নেতৃত্বের নৈতিক দায়িত্ব। 'মুখে শাহ ফরিদ, বগলে ইট'- এই নীতি অবলম্বন করে কোনো ভিত্তিহীন অজুহাত দেখিয়ে নির্বাচনটি বানচাল করলে তার কঠিন দায়ভার ভবিষ্যতে তাদেরই বহন করতে হবে। ৯২ দিনের হরতাল-অবরোধ সরকার হটাতে পারেনি, তা সত্ত্বেও একটা সম্মানজনক 'এক্সিট রুট' তাদের জন্য তৈরি হয়েছে। সেটি বন্ধ হয়ে গেলে যে সামাজিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে তার রূপ এতই ভয়াবহ হবে যে, উভয় জোটের জন্যই অকল্পনীয় দুর্যোগ ও দুর্দশা নেমে আসবে এবং প্রস্থানের সব পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। কারণ এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত হরতাল-অবরোধ শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর কোথাও সরকার পরিবর্তন করতে পারেনি। শুধু সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর পথ উন্মুক্ত করেছে। '৯০-এর আন্দোলনেও এরশাদ সাহেবকে দুই জোটের সম্মিলিত আন্দোলন সরাতে সক্ষম হয়েছে। তারও মুখ্য কারণ ছিল তৎকালীন চিফ অব স্টাফ জনাব নূরুদ্দীনের ক্ষমতাগ্রহণে অপারগতা বা অক্ষমতা। বর্তমান অবস্থায় এটি প্রদীপ্ত সূর্যালোকের মতো নিষ্কলুষ সত্য যে, বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থানের সুযোগ একেবারেই নেই। এই বাস্তবতার অন্তর্নিহিত কারণটি শুধু দুই জোটই নয়, জনগণও অবহিত। প্রশাসনিক সুবিধার কথা বলে দেশের প্রতিটি জেলায় একজন করে জেলা পরিষদ প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তাদের কোনো কাজ নেই বা কিছু করার সুযোগ নেই এমনকি অনেক জায়গায় অফিস পর্যন্ত নেই। উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হচ্ছে বটে, কিন্তু চেয়ারম্যানদের ক্ষমতা খর্ব করে দিয়ে আদতে তাদের ঠুঁটো জগন্নাথ করে রাখা হয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্যদের ইচ্ছার বাইরে তাদের কোনো কিছু করা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নেই।
একই নগরে দুই নগরপিতা! এটা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। লন্ডন, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, দিল্লি, প্যারিস, টোকিও বা কলকাতা- পৃথিবীর কোনো বড় শহরকেই প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য দুই ভাগ বা চারভাগ করতে হয়নি। আমি এর আগে এর বিরোধিতাও করেছি। কিন্তু এখন মেনে নিচ্ছি এই কারণে যে, তবুও আসন্ন নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হোক। কেননা আসন্ন নির্বাচনটি চলমান সাংঘর্ষিক অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য একটি 'এক্সিট রুট' হিসেবে কাজ করবে এবং সামাজিক বিপর্যয়ের হাত থেকে আল্লাহর অশেষ রহমতে জাতি রক্ষা পেতে পারবে। নির্বাচনটি বৃহত্তর সংকট উত্তরণের একটি পথ উন্মুক্ত করবে।
লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।