শুভ নববর্ষ বাঙালির জীবনে এ এক বহু কাঙ্ক্ষিত দিন। আল্লাহ আমাদের ১৬ কোটি মানুষকে বাংলা নববর্ষের অনাবিল আনন্দে ভরিয়ে দিন। বছরটি যেন আমাদের জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধির হয়।
আমাদের অবস্থানের আজ ৭৮ দিন। মতিঝিলের ফুটপাথে একনাগাড়ে ৬৫ দিন থেকে এখন কর্মসূচি সারা দেশে বয়ে বেড়াচ্ছি। গত পর্বে লিখেছিলাম ৬ তারিখ জাতীয় স্মৃতিসৌধের গেটে ছিলাম। কী বলব, আমি যাওয়ার আগে যেখানে শান্তির ব্যানার লাগাতে দেয়নি। গেটের ডানপাশে তাঁবু টানিয়ে যখন শুয়েছিলাম, তখন দেখি স্মৃতিসৌধের সব জায়গায় বাতি আছে, শুধু আমার মাথার উপর নেই, হঠাৎ করেই বন্ধ করে দেয়। কেন যেন মন ভারি হয়ে এসেছিল। হায়রে কপাল! শহীদের স্মৃতিতে নির্মিত সৌধে সবখানে বাতি আছে, আমি জীবিত বলে আমার মাথার উপর নেই। একজন মুক্তিযোদ্ধার বেঁচে থাকা কত বড় অপরাধ, ভেবে কোনো কূলকিনারা পাইনি। ৭ তারিখ পদ্মার পশ্চিম পাড়ে আমাদের পাঁচ্চরে থাকা হয়নি। ৭ তারিখ রাত কাটিয়েছি কর্নেল ফারুক খানের নির্বাচনী এলাকা কাশিয়ানীর হোগলাকান্দি কুমার নদের পাড়ে ১৫৬নং হোগলাকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছোট্ট মাঠে। সে কি বৃষ্টি! অমন দুর্যোগ খুব একটা মোকাবিলা করিনি। কত মানুষ এসেছিলেন। কত মুক্তিযোদ্ধা, যার মধ্যে আওয়ামী লীগই বেশি। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সাংবাদিক সালাউদ্দিন রাজ্জাক তার বিয়েতে দাওয়াত করেছিল। কথা ছিল, যাব। কিন্তু বাইরে থাকায় যেতে পারিনি। তাই ধরেছিল টুঙ্গিপাড়া যাওয়ার পথে তার গ্রামে যেতে। রাজি হয়েছিলাম। বিয়েতে যাওয়া হয়নি, একেবারে বাড়িতে গিয়েছিলাম। বড় তৃপ্তি নিয়ে তার বাড়ি দুই বেলা খেয়েছি। সালাউদ্দিনের বোনের মেয়ে আড়াই-তিন বছরের ফাতেমা বড় অসাধারণ। আমরা বসতে বসতেই এক ফলের বাটি নিয়ে ছুটে এসেছিল ফাতেমা- যেটা মনে হচ্ছিল তার চেয়ে ভারী। কোলে চড়ে যাওয়ার পথে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি কোলে কেন? হাঁটতে পার না? সঙ্গে সঙ্গে জবাব, আমার পা নেই, হাত নেই, নাক নেই, ঠোঁট নেই। এক সময় বলে বসল, আমিও নেই। ফুলের মতো হাসিখুশি অসাধারণ ছোট্ট মেয়ে। পরদিন চলে আসার পথে প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চারা মন কেড়ে নিয়েছিল। মিম্মা, সখিনা এটা ওটা জিজ্ঞেস করছিল। এক সময় মিম্মা বলেছিল, আঙ্কেল, বিস্কুট খাবেন? বলেই ছুটে গিয়ে আগের দিন স্কুলে দেওয়া সরকারি বিস্কিট নিয়ে এসেছিল। একটা বিস্কিট আমি খুব তৃপ্তি সহকারে খেয়েছিলাম। একটু পরে সালাউদ্দিনের বাড়িতে নাশতা খেয়ে রওনা দেওয়ার আগে স্কুলের সব বাচ্চা ঘিরে ধরেছিল। কিছুতেই ছাড়তে চাচ্ছিল না। মিম্মারা কজন মিলে একটা কলম উপহার দিয়েছিল। বাচ্চারা কলমটি যখন দেয় তখন বুঝতে পারছিলাম না, আমি স্বর্গে, না মর্তে। কোনো দিন দেখিনি, মাত্র এক রাত ছিলাম, সকালে এক-দুই ঘণ্টা কথা হয়েছে। তাতেই এত মায়া। একদল ছোট্ট বাচ্চার একটা কলম উপহার আর ধনবানের বিএমডবি্লউ-মার্সিডিজ গাড়ি উপহারে পার্থক্য কী? আনন্দে কৃতজ্ঞতা ভালোবাসায় বুক ভরে গিয়েছিল। গাড়িতে যখন উঠতে যাচ্ছিলাম কম করে ৩০-৪০ জন একজন আরেকজনকে ধাক্কাধাক্কি করে আমার দুই হাত ধরার চেষ্টা করছিল। ওভাবে কিলবিল করা বাচ্চাদের সঙ্গে হাঁটা যায় না। পায়ে পা লেগে কতবার পড়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে। কী করব! ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চা কিছুতেই ছাড়ছিল না। কয়েকজন বলছিল, দাদু তোমার জন্য কান্না পাচ্ছে। আমারও যে বুক তোলপাড় করছিল না, তা তো নয়। আজ ৫-৬ দিন পর যখন লিখছি, তখনো হোগলাকান্দির ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাদের কেন যেন ভুলতে পারছি না। এক মুহূর্তে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা, বাচ্চা-কাচ্চার মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছিলাম।
৮ তারিখ টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারতের কথা ছিল। যে কারণে ছেলেমেয়ে নিয়ে নাসরীন সরাসরি ঢাকা থেকে রওনা হয়েছিল। কাশিয়ানীতে যখন ছিলাম তখন জানলাম আমার স্ত্রীর শিশুকালের বন্ধু রেনুর বাড়ি পাশের থানা মুকসুদপুরে। আমি যেখানে ছিলাম সেখান থেকে খুব একটা বেশি দূর নয়, ১২-১৩ কিলোমিটার হবে। আমার স্ত্রী ছোটকালের বন্ধুদের জন্য পাগল। ওর ভালো লাগবে, খুশি হবে সেজন্য মুকসুদপুরের বনগ্রামে বিজনকান্তি সাহা কানুর ছোট বোন রেনুর বাড়ি গিয়েছিলাম। কানুর দাদা নির্মল সাহা ১৯৬০ সালের দিকে জুট ইন্সপেক্টর হিসেবে টাঙ্গাইলে গিয়েছিলেন। সেই থেকে ওদের সঙ্গে পরিচয়। একেবারে নিচের ক্লাস থেকে বন্ধুত্ব। মুকসুদপুরের বনগ্রামে রেনুদের বিশাল দোতলা বাড়ি। সেখানে এক নব্য আওয়ামী লীগার এনিমি প্রপার্টির দোহাই দিয়ে একেবারে পেটের ভিতর গোদের উপর বিষফোঁড়ের মতো ঘর তুলে দখলের চেষ্টা করছে। যদিও এখন আর এনিমি প্রপার্টি বলে কিছু নেই। এ জন্য মুক্তিযোদ্ধা হান্নান ফকির ভীষণ ক্ষিপ্ত। আমিও এক সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এলাকা দেখাশোনাকারী আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক জনাব শেখ আবদুল্লাহকে বলেছিলাম। আর বিজনকান্তি সাহা কানু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে ৭-৮ বছর থেকে তাকে দেখাশোনা করেছে। তাই তার সম্পত্তি নিয়ে এত টানাটানি হবে ভাবতেই পারিনি। কিন্তু তারপরও কী করা যাবে- হয়েছে। ৮ তারিখ দুপুরে বনগ্রামে রেনুদের বাড়িতে খেয়ে সোজা টুঙ্গিপাড়ায় সেই কাতার বাকা মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় করেছি। টুঙ্গিপাড়ায় যাওয়ার পথেই আমাদের নারায়ণগঞ্জ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি শফিকুল ইসলাম দেলোয়ার এবং তার বড় ভাই দলবল নিয়ে ফিরে গিয়েছিল। টুঙ্গিপাড়া বঙ্গবন্ধুর কবরে সব সময় আমার ভীষণ ভালো লাগে। ২ এপ্রিল গিয়েছিলাম হুজুর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর কবরে, ৮ তারিখ আমার রাজনৈতিক পিতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কবরে। টুঙ্গিপাড়া এখন আর আগের মতো নেই, অনেক দালানকোঠা উঠেছে। কিন্তু প্রাণ মরে গেছে। জনাব শেখ সেলিমের বাড়ির গেট বন্ধ, শিকের ফাঁক দিয়ে পাতা পড়ে থাকতে দেখলাম। আমু ভাইর শ্বশুরবাড়িতে বড় ভাই ছাড়া কেউ নেই। মাজারের উত্তরে মুন্নীদের বাড়ি। মুন্নীর বিয়ে হয়েছে, রুনু কাজী, সেও নেই। অনেক দালানকোঠা হয়েছে, কিন্তু জীবনের কোলাহল চোখে পড়েনি। যখন কিছুই ছিল না, তখন বঙ্গবন্ধুর কবরে পায়ের কাছে যেখানে শুয়ে থাকতাম, এবারও সেখানেই ছিলাম। ফজরের আজানে ঘুম ভাঙে। নামাজ আদায় করে বসতে বসতেই কবরের গার্ড বাহিনীর লোকেরা নাশতা দিয়েছিল। গার্ড বাহিনীর সাব-ইন্সপেক্টর ফরিদ আমার বাসাইল থানার কাশিলের লোক। বড় যত্ন করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির কেয়ারটেকার বৈকুণ্ঠ, নির্মল, আতিয়ার তাদের সেবাযত্নের তুলনা হয় না। বিশেষ করে আক্কাস সারা রাত জেগেছে। অজুর জন্য বাথরুম খুলে রেখেছে। তাদের অসাধারণ আন্তরিকতা আমাদের মুগ্ধ করেছে। বিশেষ করে আক্কাস, আমরা যখন টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতাম তখন রাস্তার দুই পাশের জঙ্গল পরিষ্কার করত। ছোট বাচ্চাদের মধ্যে আক্কাস, ওবায়দুল এরা হাত মিলাত, আমার সঙ্গে রাস্তা ঝাড়ু দিত। মেয়েদের মধ্যে ছোট্ট রুনু কাজী থ্রি-ফোরের মেয়ে মামা মামা বলে ছায়ার মতো লেগে থাকত। সেই আক্কাস সবাইকে নাশতা খাইয়েছে। নির্মল ঘুম ভাঙতেই চা এনে দিয়েছিল। রাতে দুই রুটি খেয়ে যেমন আনন্দে রাত কাটিয়েছিলাম, সকালের নাশতাও ছিল ঠিক সেই রকম। নির্মল, আক্কাস, পুলিশরা যে নাশতা দিয়েছিল তা আরও ১০ জনকে খাইয়েছিলাম। টুঙ্গিপাড়া গেলে ওরা যে কী ভালোবাসে হৃদয় ছিঁড়ে যেতে চায়। কারও জন্য কিছুই করতে পারি না, তবু বড় বেশি ভালোবাসে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর টুঙ্গিপাড়ায় বাড়ি। কিন্তু আশপাশে অনেক অসহায়ের বাস। বলতেই যেন কেমন লাগে। সবকটা বাড়িতে একটা করে চাকরি হলে হয়তো এত কষ্ট থাকত না। বঙ্গবন্ধুর কবরের পাশে কয়েকটা ঘণ্টা বড় আনন্দে কেটেছে। সাড়ে ১০টার দিকে রওনা হয়েছিলাম। ফেরিতে কোনো অসুবিধা হয়নি। শ্রমিক লীগের সভাপতি শুকুর মাহমুদ সেই '৯০ সাল থেকে সব সময় টুঙ্গিপাড়ায় যাওয়া-আসায় অসম্ভব সহযোগিতা করে, এবারও করেছে। ফেরি পার হয়ে সিরাজদিখানের কুচিয়ামোড়া বিক্রমপুর আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে ছেলেমেয়ে স্ত্রী নিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে রাত কাটিয়েছি। মাঠের পাশেই আসিফদের বাড়ি। রাতে আসিফের মা সবজি পাঠিয়ে বলেছিল, সকালের নাশতা দেবে। মানুষের কত মায়া! জানা নেই, শোনা নেই এক অপরিচিত গৃহকর্ত্রী ভিনদেশি মুসাফিরদের জন্য সে কি মায়া। সকাল ৭টায় ক্লাস নাইনের শ্যামলা এক ছোট্ট ছেলে আসিফ রুটি, পরটা, ডিম, ডাল নিয়ে হাজির। আমি খুব একটা ডিম খাই না, পরটাও না। সকালে সাধারণত ছোট ১-২টা আটার রুটি খেয়েই নাশতা করি। গরম পরটা একটু ছিঁড়ে মুখে দিতেই এক অসাধারণ স্বাদ অনুভব করি। একটু-আধটু খেতে খেতে একটা পরটা পুরোটাই খেয়ে ফেলি। দুটার বেশি খাব না, তাই আরেকটা একটু ডিম দিয়ে খাই। পরে কোনো কিছু ছাড়াই আর একটা খেয়ে ফেলি। বড় ভালো লেগেছে কুচিয়ামোড়ার কলেজ মাঠে। আবার কালো দিক হলো, আমাদের নেতা নারায়ণগঞ্জের পারভেজ গিয়েছিল কলেজের প্রিন্সিপালের কাছে। তিনি বড় খুশি হয়ে জানিয়েছিলেন, কাদের সিদ্দিকীর মতো একজন বরেণ্য ব্যক্তি আমাদের এখানে এলে আমরা ধন্য হব। কলেজের হল ব্যবহারে কোনো অসুবিধা হবে না। আমি পৌঁছার পর শুধু খবর দিলেই প্রিন্সিপাল ছুটে আসবেন। এটা ছিল ১০-১১টার দিকের কথা। ১২টার দিকে ভোট ছাড়া এমপি শ্রী সুকুমার ঘোষ নাকি প্রিন্সিপালকে বলেন, প্রয়োজনে কলেজের গেট বন্ধ করে রাখতে হবে। কাদের সিদ্দিকীকে থাকতে দেওয়া যাবে না। আমাদের অবস্থান কর্মসূচি কারও ঘরে নয়, সম্পূর্ণই বাইরে। আজ ৭৮ দিনে এক রাতও ঘরে থাকিনি, ঝড়-তুফান যা কিছুই হোক বাইরে রাস্তায়, মাঠে থেকেছি। কুচিয়ামোড়াতেও তাই থেকেছি। অনেক মানুষ দেখা করতে এসেছে। প্রায় সবাই ভালো মানুষ। অধিকাংশ মানুষ বিদেশে থাকায় শূন্যতা যাই থাক আর্থিকভাবে সচ্ছল। যে মাঠে তাঁবু ফেলেছিলাম সেই মাঠের পূর্বে এক সময়ের বিখ্যাত বাঙালি পৃথিবীর সেরা সাঁতারু ব্রজেন দাসের বাড়ি। বিক্রমপুর আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ এক সময় শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের বদন্যতা পেয়েছিল। কুচিয়ামোড়ায় রাতটা প্রচণ্ড শিশিরভেজা হলেও আমার ভালো লেগেছে।
কুচিয়ামোড়া থেকে ১০ তারিখ সকাল ১০টায় বনানী কবরস্থানে জাতীয় তিন নেতা এবং বঙ্গবন্ধুর পরিবারের নিহতদের কবর জিয়ারত করে ঠিক ১১টা ১০ মিনিটে বীরউত্তম জিয়াউর রহমানের কবরে গিয়েছিলাম। কি এক টিভি চ্যানেল জিজ্ঞাসা করেছিল, কী কারণে সেখানে গেছি। কিছু বলার ইচ্ছা ছিল না, তবু বলেছিলাম একজন মুসলমান হিসেবে আরেকজন মুসলমানের কবরে ফাতেহা পাঠ করতে এসেছি। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জিয়াউর রহমানের কবর জিয়ারত করেছি। ২ তারিখ সকালে মতিঝিলের ফুটপাথ ছেড়েছিলাম। আবার ১০ তারিখ বেলা ২টায় অল্প সময়ের জন্য সেখানে গিয়েছিলাম। দীপ, কুঁড়ি, কুশির মা খুব শখ করে অনেক খাবার নিয়ে গিয়েছিল। ভালোভাবে তৃপ্তির সঙ্গে খেয়ে গাজীপুরের পিরুজালী স্কুল মাঠের পাশে মসজিদের সামনে তাঁবু ফেলেছিলাম।
বহুদিন এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করি, একঘেয়ে জীবনে কোনো বৈচিত্র্য নেই। পিরুজালী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ঢুকেই দেখি ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে। যদিও লোকজন অবসর দিতে চাচ্ছিল না, তবু ওর ফাঁকেই খেলা দেখছিলাম। বড় ভালো লাগছিল। কয়েকটা যুবক একটা বল নিয়ে কীভাবে লেগে থাকে। ইদানীং টেনিস বলে টেপ পেঁচিয়ে গ্রামগঞ্জের ছেলেরা ক্রিকেট খেলে। কদিন আগে টুঙ্গিপাড়া যাওয়ার পথে ফরিদপুরের ভাঙ্গার জামিয়া ইসলামিয়া কাসেমুল উলুম ঈদগাহ মাদ্রাসার মাঠে সফেদা গাছের নিচে কিছুক্ষণ বসেছিলাম। সেখানে একপাল বাচ্চা ঘিরে ধরেছিল। তাদের ব্যাট-বল কিনে দিয়েছি। একটি ছোট্ট ছেলে বড় সুন্দর করে বলে টেপ পেঁচাচ্ছিল, আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম। মাঠে কিছুক্ষণ খেলা দেখে সময় কাটিয়েছিলাম। স্কুলের সভাপতি জনাব নুরুল ইসলাম মণ্ডলের বাড়িতে রাতে খাবারের ব্যবস্থা ছিল। তার ছোট্ট ছোট্ট নাতিপুতি ঝিনুক, প্লাবন, প্রাণ অসম্ভব সুন্দর। দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। ফাতেমা, রিপা, ইয়ামিন, শিখা, স্মৃতি, কত বাচ্চা যে পেয়েছিলাম বলার মতো না। দুটি রাত বড় আনন্দে কেটেছে। কতজন কতভাবে খাবার এনেছে, কোনো সমস্যা হয়নি। গাজীপুরের এসপি নামকরা আওয়ামী লীগার। তাই তার কাছে সাধারণ সৌজন্য বা নিরাপত্তা পাওয়া যায়নি, বরং উসকানি পাওয়া গেছে। ১১ তারিখ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মাওনা ফ্লাইওভার উদ্বোধন করেন। আমাকে নিয়ে নাকি এসপি খুব চিন্তায় ছিলেন। যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যাত্রাপথে বাধার সৃষ্টি করি। কী বলব? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মাওনা গিয়েছিলেন আকাশপথে। আমি তখন পিরুজালী স্কুলের পাশে মসজিদের সামনে তাঁবুতে। আমার কোনো আকাশযান ছিল না, বাধা দেব কী করে? আর বাধা দিতে যাবই-বা কেন?
যাক ওসব কথা! গরিব মানুষের একটা ঘটনা বলি। ১১ তারিখ সাড়ে ১১-১২টার দিকে ফাতেমাতুল মৌ নামে ক্লাস ওয়ানের ছোট্ট একটা মেয়ে তার নানী মাজেদাকে নিয়ে এসেছিল। এক ডিশ ভাত, সঙ্গে ৫-৬ রকমের ভাজি-ভুজি, সবজি। তিসি বাটা, ডাঁটার তরকারি, আলু ভাজা, কুমড়া ভাজা, কাঁচা কলা দিয়ে মাছের ঝোল- সে এক এলাহি কারবার। জানা নেই, চেনা নেই ছোট্ট বাচ্চা এসে বলল, 'দাদু তোমার জন্য খাবার এনেছি।' সেই খাবার খেতে গিয়ে যাদের খাবার খাওয়ার কথা ছিল তাদের খাবার খাওয়া হয়নি। আরও কতজন খাবার এনেছিল। স্কুলের হেডমাস্টার আবু আহমেদ, অন্য শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের সামনে দুই কথা বলতে অনুরোধ করেছিলেন। বলার ইচ্ছা ছিল না, তবু দুই কথা বলেছি, বাচ্চাদের মধ্যে বেশ চেতনা লক্ষ্য করেছি। তারা দেশের হানাহানিতে খুবই উদ্বিগ্ন, দুই নেত্রীর প্রতিও বেশ বিক্ষুব্ধ। শান্তির জন্য অবস্থান কর্মসূচিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা স্বাক্ষর করেছে। দূর থেকে ছেলেমেয়েদের স্বাক্ষর করতে দেখে মনে হয়েছে, ওর মধ্যে একজনও যদি সত্যিকারের মানুষের মতো মানুষ হয়, তাহলেই আমার এ কষ্টের সার্থকতা।
ফাতেমাতুল মৌ নানী মাজেদার সঙ্গে ভাত নিয়ে এসেছিল। মৌ-এর মা সাবিনা যখন খুব ছোট তখন সে বিধবা হয়েছে। অনেক কষ্টে মেয়েকে পড়াত। মনে হয় সেভেন-এইটের সময় বার্ষিক পরীক্ষায় সে প্রথম হয়। সাবিনা যখন মাকে গিয়ে বলে তার রোল এক হয়েছে। মাত্র এক হয়েছে শুনেই সাবিনার মা মাজেদা রেগেমেগে আগুন। চিৎকার করে মেয়েকে মারতে থাকে, 'আমি কষ্ট করে তোরে পড়াই, তুই মাত্র এক নম্বর হইলি?' মারতে মারতে মেয়েটির হাত-পা ফাটিয়ে ফেলে রা রা করে স্কুলে যায়। সব মাস্টারকে জড়ো করে, 'আমি গরিব মানুষ বলে আপনারা আমার মেয়ারে এক নম্বর বানান। আর ধনী মানসের কত ছেলেমেয়ে ১০ নম্বর, ১৫ নম্বর, এমনকি ৫০ নম্বর হয়। কত কষ্ট করে মেয়েটারে পড়াই। আপনেগোরে দয়া নাই। আপনাগো স্কুলে আর আমার মেয়া পড়ামু না।' সেই যে মেয়ে নিয়ে গিয়েছিল তাকে আর স্কুলে যেতে দেয়নি। এক সময় বিয়ে হয়। বিয়ে কতটা ভালো হয়েছে বলতে পারব না। ছোট বাচ্চা ফাতেমাকে যখন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তোমার বাবা কোথায়? সে বলেছিল, 'চাকরি করার কথা বলে এক মাস আগে ভালুকা গেছে। যাওয়ার সময় তারে কোলেও নেয়নি।' বলেছিলাম, বাবা তোমাকে আদর করে না? মেয়েটি বলছিল, 'আমি বাবা বাবা করলে আমার দিকে বড় চোখ করে তাকায়। খুব একটা কোলে নেয় না।' কথাগুলো শুনে আমার কেমন যেন লাগছিল, ঔরসজাত সন্তান তাকে আদর না করে থাকা যায়? গরিব হলেই যে সন্তানকে আদর করতে হবে না, এমন তো নয়। বরং ধনবানদের চেয়ে নিঃস্ব-রিক্তরাই সন্তানের জন্য বেশি ভাবে। সাবিনার মা এলে হেডমাস্টার আবু আহমেদ আমায় যখন ঘটনাটি বলছিলেন, তখন সাবিনার মা মাজেদা কিছুটা লজ্জিত হয়ে বলছিল, 'মূর্খ মানুষ, আমি কী সেই সময় বুঝতাম। আমার মনে হইছে মাদবরগোরের ছেলে মেয়েগো আপনেরা ১০, ২০, এমনকি ৫০ নম্বর দেন। আমি কত কষ্ট করে টাকা-পয়সা সংগ্রহ করে মেয়া পড়াই। আমার মেয়ারে শুধু এক দিলেন?' পরীক্ষা দিয়ে স্কুলের রোল এক হওয়া যে ভালো সেটা সে তখন বুঝতে পারেনি। এখন কিছুটা বুঝে। পিরুজালী থেকে যখন চলে আসি তখন অনেক বাচ্চার মন ভারী হয়েছিল, আমারও যে হয়নি তা নয়। সেখান থেকে এম. সি. বাজারে হাজী ছোট কলিম উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে তাঁবু ফেলেছি। এখানকার ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, সাধারণ মানুষ অসাধারণ। চারদিকে শিল্প-কারখানা, তাই বাইরের মানুষ বেশি। বড় বেশি আশ্চর্য হয়েছিলাম সাধারণ মানুষ এবং সাংবাদিকরা পর্যন্ত আমার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। সন্ধ্যার দিকে কয়েকজন সাংবাদিক ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, 'মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মাওনা এসেছিলেন। সেখানে ১০ হাজার পুলিশ ছিল। আপনি একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রবীণ নাগরিক, আপনার জন্য ১০ জন পুলিশের ব্যবস্থাও নেই, এ কেমন কথা?' বলেছিলাম, বন্ধুরা অধৈর্য হবেন না, সবই আল্লাহর ইচ্ছা।
লেখক : রাজনীতিক।