বর্ষবরণের দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় যৌন নির্যাতনের ঘটনায় জাতি স্তম্ভিত, হতবাক। জনারণ্যে পুলিশের উপস্থিতিতে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনায় ক্ষুব্ধ গোটা দেশ। নারী সমাজসহ মুক্তচিন্তার মানুষ নানাভাবে এর প্রতিবাদ করছে। সেদিনের যৌন হয়রানির ঘটনায় সম্পৃক্ত কয়েকজনকে শনাক্ত করা গেলেও পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। পুলিশের ভাষায়- নববর্ষ উপলক্ষে রমনা চত্বর, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে ছিল তিন স্তরের নিরাপত্তা। বর্ষবরণের দুই দিন আগে পুলিশ কমিশনার নিজে সেখানে গৃহীত নিরাপত্তাব্যবস্থা তদারকি করেন। সব সড়ক ও উদ্যানে ১৩১টি সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়। এমন নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকার পরেও পুলিশের নাকের ডগায় কীভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটল? পুলিশের ভূমিকাই বা কী ছিল?
ডিএমপি যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম একটি দৈনিক পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বেশ কিছু দিন ধরে পয়লা বৈশাখের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো হচ্ছিল। একটি মহল পয়লা বৈশাখকে 'শিরক' বলে প্রচার চালাচ্ছিল। যারা এ প্রচারণা চালাচ্ছে তারাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। তিনি এ ঘটনা পরিকল্পিত বলেই মনে করেন। পুলিশ যদি জানতই পয়লা বৈশাখের বিরুদ্ধে প্রচারণা চলছে তাহলে পুলিশ সতর্ক ছিল না কেন? সিসিটিভি ক্যামেরাও নাকি এমনভাবে ফিট করা ছিল যাতে অপরাধীদের ছবি স্পষ্ট হচ্ছে না। তাহলে এসব ঘটনার কী যোগসূত্র আছে? পুলিশের সিসিটিভি ক্যামেরায় স্পষ্ট না হোক কয়েকটি টেলিভিশনের ক্যামেরা ফুটেজে তো তাদের চেহারা স্পষ্ট। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের ছবি ছড়িয়ে পড়েছে। তাহলে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে পারছে না কেন? প্রথমে তো পুলিশ বলেই দিয়েছিল কোনো মহিলাকে বিবস্ত্র করার ঘটনা ঘটেনি। ছাত্ররা অপরাধী দু-একজনকে ধরে পুলিশের কাছে দিলেও পুলিশ তাদের ছেড়ে দেয়। পুলিশ এখানে হামলাকারীদের রক্ষাকবচ হিসেবেই কাজ করেছে। পুলিশ কি ধরে নিয়েছিল যে, এসব দুর্বৃত্ত ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের কর্মী? তাদের গ্রেফতারে নিষেধাজ্ঞা আছে? তারা কি জানে না রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট ভাষায় বার বার বলছেন, অপরাধীরা যেই হোক না কেন তারা নিছক অপরাধী। ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে চার তরুণের একটি গ্রুপ। তারা বেশ কয়েক জায়গায় যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটিয়েছে সংঘবদ্ধভাবে, পরিকল্পিতভাবে।
অনেক দিন ধরে বাঙালি সংস্কৃতির মূলে কুঠারাঘাত করার পাঁয়তারা চলছে। বাঙালির সর্বজনীন উৎসব পয়লা বৈশাখ। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি এ উৎসবে মেতে ওঠে। মৌলবাদী অপশক্তি এ সংস্কৃতি ধ্বংসের অপচেষ্টায় লিপ্ত। সবসময় মৌলবাদী শক্তি নারীর স্বাধীন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে চেয়েছে। বছরের পর বছর ধরে পরম্পরায় নিজস্ব সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে লালন করে এসেছে নারীই। তাই নারীর ওপরই মৌলবাদী অপশক্তির রাগ ও ক্ষোভ বেশি। বর্ষবরণের দিনে যা ঘটেছে তা অবশ্যই পরিকল্পিত। ক্যামেরার ফুটেজগুলো বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র এ ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে। তারা বহিরাগত, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ নয়। এ ঘটনাগুলোর পেছনে নারী কী পোশাক পরেছিল, এ বিষয়গুলো গৌণ। আমরা জানি পয়লা বৈশাখে বাঙালি নারী বাঙালি সাজেই সাজে, তা খুবই শালীন এবং সুন্দর। হামলাকারীদের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ। এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা এর আগে রমনা বটমূলে বোমা হামলারই ধারাবাহিকতা। বর্ষবরণ উৎসবে মৌলবাদীদের থাবা পড়বে এটা জানা সত্ত্বেও পুলিশ যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি। এ জন্য কে বা কারা দায়ী তা খুঁজে বের করতে হবে। আর যৌনসন্ত্রাসীদের অবিলম্বে খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেওয়া হোক- দেশবাসীর এটাই প্রত্যাশা। তাহলেই এ ধরনের জঘন্য ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না বলে সচেতন মহলের ধারণা। আর এমন লজ্জাজনক পরিস্থিতি থেকে জাতিকে বাঁচাতে হলে মধ্যযুগীয় বর্বর মৌলবাদী অপশক্তির বিরুদ্ধে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ভেঙে দিতে হবে মৌলবাদের বিষদাঁত। গড়ে তুলতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এক বাংলাদেশ।
লেখক : সাংবাদিক