১. মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনপ্রবাহের এই সময় পরিসর অনন্ত কালপ্রবাহের কাছে যে কত ক্ষুদ্র তা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। আমাদের জীবনপ্রবাহে নানা বাঁক থাকে, তা সবসময় সরলভাবে এগোয় না। এসব বাঁকে মানুষ কিন্তু থেমে থাকে না। তারা পরিস্থিতি অনুকূলে রাখার প্রত্যয়ে কখনো হয়তো সাময়িকভাবে থমকে দাঁড়ায়, কখনোবা সিদ্ধান্ত নিয়ে তার পথচলা নির্ধারণ করে নেয় আবার কখনোবা অদৃষ্টের হাতে ভাগ্যকে সোপর্দ করে সামনে এগোবার চেষ্টা চালিয়ে যায়। জীবনের এ নানা বাঁকে চলতে গিয়ে অনেককে অবশ্য ঘাট পরিবর্তন করতে দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে আমরা দেখেছি চট্টগ্রামের এক সময়ের নির্বাচিত এবং সদ্য সমাপ্ত চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ মনজুর আলমকে। তিনি এক সময় ছিলেন নৌকার যাত্রী, কয়েক বছর হলো বইতে শুরু করেছেন ধানের শীষের অাঁটি।
এ বছর ঢাকা সিটি করপোরেশনের (উত্তর) নির্বাচনেও আমরা এরকম চিত্র লক্ষ্য করছি। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এক সময়ের এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু ছিলেন আওয়ামী নৌকার এক শক্তিশালী বৈঠাওয়ালা। কী কারণে যেন তিনি পরে বনে গেলেন বিএনপির এক নিবেদিত নেতায়; আস্তে আস্তে উপনীত হলেন দলটির অন্যতম একজন কর্ণধার হিসেবে। এখন আবদুল আউয়াল মিন্টুকে মানুষ বিএনপির নেতা হিসেবেই জানে, তিনি বিএনপি নেত্রীর খুবই কাছের একজন উপদেষ্টা। মিন্টু একজন সজ্জন এবং আচারি মানুষ। ব্যবসায়ী-রাজনীতিক হলেও ঢাকা এবং বিশেষ করে তার এলাকা নোয়াখালীর ব্যাপক মানুষের সঙ্গে তার যথেষ্ট মিথস্ক্রিয়া বা ইন্টারঅ্যাকশন রয়েছে। ঢাকার মানুষ অনেকেই জানেন যে দীর্ঘদিন থেকে মিন্টু ঢাকার নগরপিতা হওয়ার স্বপ্ন লালন করে আসছেন। এ ব্যাপারে ঢাকার মানুষের কাছে ভবিষ্যতের মেয়র হিসেবে তার একটা ইমেজও গড়ে উঠেছিল।
এ বছর ঢাকা সিটি নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হওয়ার সময় থেকেই মেয়র পদে নির্বাচনের ব্যাপারে তার নাম কিন্তু সামনেই চলে এসেছিল। বিএনপি সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে দলটির সর্বস্তরের নেতা-কর্মী এমনকি সমর্থক গোষ্ঠীও মিন্টুকেই তাদের মেয়র প্রার্থী হিসেবে ভেবে নিয়েছিলেন। ভয় ছিল বিভিন্ন মামলার কারণে তিনি তার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারবেন কি-না? ব্যাংক ঋণ (ধনী ব্যবসায়ীদের প্রায় সবারই থাকে), মালিমামলা প্রভৃতি ঝক্কি-ঝামেলা কাটিয়ে অবশেষে ২৮ এপ্রিলের নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি ঢাকা উত্তর থেকে নির্বাচনের জন্য মেয়র পদে মনোনয়নপত্র জমা দিলেন। সঙ্গে তার ছেলে তাবিথ আউয়ালের নামেও একটি মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। আবদুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে তাবিথ আউয়াল নামটি তখনই আমরা প্রথম জানলাম। পরে শুনেছি তিনিও একজন লেখাপড়া জানা, সজ্জন এবং রুচিবান মানুষ। তিনি মূলত বাবার ব্যবসায় সাম্রাজ্যই দেখাশোনা করেন।
গোল বাঁধল নমিনেশন পেপার স্ক্রটিনির সময়। আবদুল আউয়াল মিন্টুর কেসকাণ্ড কিংবা ঋণগ্রস্ততা এসব কোনো অপমানকর কারণে নয়, নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসার ছোট্ট (মাইনর) একটি কারণে তার প্রার্থিতা বাতিল করে দিলেন। এ যেন পচা শামুকে পা কেটে যাওয়া। তার প্রার্থিতা বাতিলের কারণ হিসেবে রিটার্নিং অফিসার তার আইনজীবীদের কাছে উল্লেখ করলেন যে, মিন্টুর প্রার্থিতা যারা প্রস্তাব এবং সমর্থন করেছেন তাদের কেউ একজন নিজেই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ভোটার নন, এটা নির্বাচন আইনের বরখেলাপ। কাজেই তার প্রার্থিতা বাতিল। এবার শুরু হলো উকিল-ব্যারিস্টারদের দৌড়ঝাঁপ। এখানে নেতৃত্ব দিলেন সুপ্রিমকোর্ট বার সমিতির দুবারের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। তার নেতৃত্বে আইনজ্ঞ দল গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে, প্রেস কনফারেন্স করে মানুষকে বুঝাতে চাইলেন এটা কোনো ব্যাপারই নয়- 'ইট ইজ অ্যা মাইনর মিসটেক'। 'মাইনর' মিসটেক যে এত বড় 'মেজর'-এ পরিণত হতে পারে তা তারা স্বীকারই করতে চাইলেন না। তারা বিভাগীয় কমিশনারের কাছে, অতঃপর হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট সব জায়গায় দৌড়ঝাঁপ করলেন। কিন্তু কিছুতেই কাজ হলো না বরং যা হওয়ার তাই-ই হলো। মিন্টু মেয়র নির্বাচনের জন্য প্রার্থীই হতে পারলেন না। নির্বাচনী আইনে পরিষ্কার বলা আছে- প্রার্থীর প্রস্তাবক/সমর্থক নির্বাচনী এলাকার ভোটার হবেন। এখানে মাইনর আর মেজর বলে কোনো অনুষঙ্গ নেই- ব্যাপারটি আগে থেকেই আমজনতা উপলব্ধি করতে পারলেও ব্যারিস্টারের তা বুঝতে সময় লাগল বেশ কয়েক সপ্তাহ।
যাই হোক এ মাইনর মিসটেকে প্রার্থিতা বাতিল হওয়ায় মিন্টুর কতটা লাভ বা কতটা ক্ষতি হয়েছে মানুষ এখন তা নিয়েই নানামুখী আলোচনা করছে। অনেকের ধারণা, মিন্টুর এ 'মিসটেক' ইন্টেনশনাল। মিন্টু তার ব্যবসা-বাণিজ্যের ভূত-ভবিষ্যৎ অাঁচ করে নিজেই নাকি এ 'মিসটেক'টি করেছেন, এর মাধ্যমে তিনি একুল-ওকুল দুটোই রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। তিনি আসলে কী করেছেন বা কী করেননি কিংবা কেন 'মিসটেক'টি করেছেন তা আমাদের জানা সম্ভব নয়। তবে আমরা একটা জিনিস দেখলাম, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি তার দল বিএনপিতে তার 'রাজনৈতিক ওয়ারিশ' তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। তার সন্তান তাবিথ আউয়াল বিএনপির মতো একটি বড় দলের প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছেন। তাবিথ আউয়াল বিএনপির কোনো পর্যায়ের আদৌ একজন সদস্যও কিনা তা আমাদের জানা নেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এ দলটির বাঘা বাঘা নেতাকে টপকে তাবিথই হয়েছিলেন ঢাকা উত্তরের বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী। এ যেন জন্মেই এক প্রকার সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ অথবা গাছ না লাগিয়েই সেই গাছ থেকে পাকা ফল খাওয়া আর কী।
রাজনৈতিক ওয়ারিশ হিসেবে এ দেশে অনেকেই এখন প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদ। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বঙ্গবন্ধুর ওয়ারিশ। তবে তিনি কিন্তু ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য হয়ে আওয়ামী রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ও এখন হালকাভাবে হলেও আওয়ামী রাজনীতির মাঠে। তিনিও কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্যপদ নিয়েছেন পীরগঞ্জ থেকে। বিএনপি নেত্রী খালেদাপুত্র তারেক রহমানও যতটুকু জানি বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হয়ে পরে দলের সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান হয়েছেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি বি চৌধুরীর ছেলে মাহী বি চৌধুরীও বিকল্পধারার সদস্য, অতঃপর নেতা। এমন আরও অনেক উদাহরণ আমরা দেখতে পাব। কিন্তু তাবিথের রাজনৈতিক ওয়ারিশানার বিষয়টি কেমন যেন একটু আকস্মিক মনে হচ্ছে। বিএনপির কিছুই না হয়ে প্রথমবারেই ছক্কা অর্থাৎ একবারেই তিনি তাদের সমর্থিত ঢাকার মেয়র প্রার্থী। ২. রাজনীতিবিদরা হয়তো কখনো কখনো এ ধরনের 'মিসটেক' করেই থাকেন। এসব মিসটেক করেও (কখনো বুঝে, কখনো না বুঝে) বহু রাজন্য ব্যক্তিত্ব অনেক সময় রাজ্য শাসন করেন, আবার কখনো কখনো খোদ রাজনীতির বড় ক্ষতিও করে ফেলেন। রাজনীতিক কিংবা রাজরাজড়াগণ অনেক সময় কোনো কোনো ঘটনাকে এতটাই সামান্য বা ক্ষুদ্র জ্ঞান করেন, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে সামলিয়ে নেওয়াই কঠিন হয়ে পড়ে, এমনকি তা অনেক সময় সম্ভবও হয় না। যেমন : গত কয়েক মাসে বিশেষ করে গেল এসএসসি পরীক্ষার সময় যখন হরতাল-অবরোধ এবং এসবের আবারণে পেট্রলবোমাসহ ধ্বংসযজ্ঞের এক উৎসব (!) চলছিল তখন একসময় বিএনপি নেতা লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান এসএসসি পরীক্ষার দিনগুলোতে হরতালের ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে একসময় বলেছিলেন, গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকারের মতো বড় কিছু অর্জনের জন্য লেখাপড়ার এতটুকু ক্ষতি আমাদের মেনে নিতেই হবে। এ ব্যাপারে বিএনপির সাবেক মন্ত্রী মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন মন্তব্য করেছিলেন- কিসের লেখাপড়া, কিসের পরীক্ষা, আগে গণতন্ত্র, পরে এসব। হায়রে নেতৃত্ব, হায়রে রাজনীতি। বিএনপির অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব উদ্দিন এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দিনের মুখেও এ ধরনের উচ্চারণ আমরা শুনেছি।
এসব উচ্চারণ বা ঘটনা যে কেবল একালেই ঘটছে তা নয়। পাঠকবৃন্দ, আপনাদের নিশ্চয়ই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সামান্য ক্ষতি (দিব্যবদানমালা) কবিতাটি মনে আছে।
বহে মাঘ মাসে শীতের বাতাস,/স্বচ্ছসলিলা বরুণা।/পুরী হতে দূরে গ্রামে নির্জনে/শিলাময় ঘাট চম্পকবনে,/স্নানে চলেছেন শতসখীসনে/
কাশীর মহিষী করুণা।/...স্নান সমাপন করিয়া যখন/কূলে উঠে নারী সকলে/মহিষী কহিলা, 'উহু! শীতে মরি,/সকল শরীর উঠিছে শিহরি,
জ্বেলে দে আগুন ওলো সহচরী- /শীত নিবারিব অনলে'।
এ সময় কাশির মহিষী রানীমার শীত নিবারণের জন্য তার সখী-সঙ্গীরা অদূরে কিছু অতি দরিদ্র মানুষের বসবাসের নিমিত্তে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু জীর্ণ কুটিরে আগুন লাগিয়ে দিল। রানী তখন তার প্রমোদক্লান্ত শত সঙ্গীদের সঙ্গে নিয়ে আগুনের উত্তাপ উপভোগ করতে লাগলেন। এদিকে উপায়ান্ত না পেয়ে এসব দীনহীন প্রজারা তখন ভূপতি অর্থাৎ রাজ দরবারে গিয়ে তাদের দুর্দশার কথা তাকে জানালেন। এ জন্য রানী এসে তাদের ব্যবহারে রুষ্ট হয়ে বললেন-
রুষিয়া কহিল রাজার মহিষী,/ 'গৃহ কহ তারে কী বোধে !/গেছে গুটিকত জীর্ণ কুটির, /কতটুকু ক্ষতি হয়েছে প্রাণীর?
অর্থাৎ এসব মানুষের গুটিকতক গৃহ তথা জীর্ণ কুটির হয়তো পুড়ে গেছে কিন্তু তাতে এমনকি ক্ষতি হয়েছে তাদের? এগুলো কী কোনো গৃহ? রাজমহিষীর এক প্রহরের প্রমোদের জন্য এমন এক-আধটু ক্ষতি হতেই পারে। আমাদের নেতানেত্রীরা এ ধরনের 'মাইনর মিসেটক' করে একদিকে যেমন নিজের ক্ষতি করছেন, এসব ক্ষতির আবরণে আবার খারাপ রাজনৈতিক কৃষ্টিও তৈরি করে দিচ্ছেন। এসবের ফাঁক দিয়ে রাজনীতিতে রাজনৈতিক ওয়ারিশানা কায়েম হচ্ছে। এটা রাজনীতির জন্য ভালো লক্ষণ নয়। এসব কারণে ত্যাগী, পোড় খাওয়া কিংবা রাজনীতির মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা রাজনীতিকরাই কিন্তু রাজনীতি থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেবে আর এভাবে এক সময় অনেক দূরে সরে যাবে। অন্যদিকে নেতা-নেত্রীকে খুশি করার জন্য রাজনীতিবিদরা সত্যকে এখন আর সত্য বলছেন না। অনেকটা দলকানা হয়ে দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে খুশি রাখার জন্য মানুষের জীবন-জীবিকা, শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার অধিকার সবকিছু নিয়ে তারা যেন পরিহাস করে যাচ্ছেন। তারা একদিকে যেমন বুঝতে চেষ্টা করছেন না যে, কোনটা 'মাইনর' ভুল আর কোনটা 'মেজর' ভুল; একইভাবে তারা ভুলে যাচ্ছেন যে, কোনটা উপদেশ আর কোনটা পরিহাস? কোনটা সামান্য ক্ষতি কিংবা কোনটা বড় ক্ষতি? সৃষ্টিকর্তা আমাদের সবাইকে সুমতি দিন।
লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট
(পিআইবি)র সাবেক মহাপরিচালক।
ই-মেইল: [email protected]