ইদানীং বিএনপি নিয়ে পত্র-পত্রিকায় এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় বেশ আলোচনা হচ্ছে। বিএনপি নেতৃত্বের ভুল-ভ্রান্তি এমন কি অবিমৃষ্যকারিতা নিয়েও চলছে নানা ধরনের বিশ্লেষণ। এ ব্যাপারে আমার ভালো লাগার কারণটা এখানে যে, বিএনপিকে ঘিরে আজ যে আলোচনা-পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ হচ্ছে, তা আমি চালিয়ে আসছি বছর খানেক আগে থেকে। বিএনপির অনেক পুরনো পরিচিতজন তা অব্যাহত রাখার আকুতি জানিয়ে বলেছেন, 'ভিতরে থেকে চাকরি হারানোর ভয়ে তো আমরা কিছু বলতে পারি না, আপনার তো চাকরি হারানোর ভয় নেই, আপনি চালিয়ে যান, আজ না হোক কাল, কাল না হোক পরশু এটা আমাদের কাজে লাগবে।' আবার কেউ বলেছেন, 'আপনি খুব নিষ্ঠুর সমালোচনা করছেন।' তাদের বলেছি, সত্য ও বাস্তব কখনো কখনো কঠিন ও নিষ্ঠুরই হয়। আমি সর্বদাই বলার চেষ্টা করেছি, বর্তমান বিএনপি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার বিএনপি থেকে বিচ্যুত, স্খলিত। প্রেসিডেন্ট জিয়ার হত্যাকাণ্ডের পর অনেকটা বাধ্য হয়েই বেগম খালেদা জিয়াকে দলের নেতৃত্ব হাতে নিতে হয়। অনেকেই হয়তো জানেন না যে, ত্রিধাবিভক্ত আওয়ামী লীগের ছিন্নভিন্ন অবস্থায় সবাই একমত হয়ে যেমন আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দলের নেতৃত্বে বরণ করেছিলেন, বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপির নেতৃত্বে আগমনটা কিন্তু তেমন মসৃণ ছিল না। বিএনপিতে তখন শক্তিশালী দুটি গ্রুপ জন্ম নিয়েছিল মূলত দলের ও সরকারের ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে। প্রথমে অস্থায়ী ও পরে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে কেন্দ্র করে একটি গ্রুপ এবং অপরটি বিদ্রোহী গ্রুপ।
এরা কেউই চাননি বেগম জিয়া দলের নেতৃত্বে আসুক এমন কি রাজনীতিতে আসুক। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়ই বিষয়টা প্রথম স্পষ্ট হয়। এখানে একটা কথা বলে নেওয়া দরকার যে, বিদ্রোহী গ্রুপ বা রিবেল গ্রুপ হিসেবে পরিচিতরা বেগম খালেদা জিয়ার কাছে যেতেন ঘন ঘন। এটা ছিল তাদের কৌশল। বিচারপতি সাত্তার গ্রুপের সঙ্গে যারা ছিলেন তাদের একটা চাপের মধ্যে রাখাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য, বেগম খালেদা জিয়াকে নেতা বানানো তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে বিচারপতি সাত্তারকে নিবৃত্ত করার জন্য তারা খুব কৌশলী ভূমিকা পালন করে। প্রথমে তারা নিজেদের পছন্দের প্রার্থীর নাম প্রস্তাব না করে বেগম খালেদা জিয়ার নাম প্রস্তাব করে। বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত একটি সভায় সংসদ সদস্য আলী তারেক এই প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু যখন বেগম জিয়ার কাছ থেকে কনফার্ম করার প্রশ্নে সভা ক্ষণিকের জন্য মুলতবি করা হয়, তারা প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেয়। কারণ, জানা যায়, এ ব্যাপারে বেগম জিয়ার সঙ্গে তাদের কোনো কথাই হয়নি। বেগম জিয়ার প্রস্তাব ছিল, বিচারপতি সাত্তারের নাম কেউ প্রস্তাব করবেন না। তিনি তেমনই নির্দেশ দিয়েছিলেন, যা রিবেল গ্রুপ জানত। বিচারপতি সাত্তারের নাম প্রস্তাব না করা হলে রিবেল গ্রুপ তাদের প্রার্থী পরিবর্তন করত। একজনের তাৎক্ষণিক বুদ্ধিমত্তার কাছে তারা পরাস্ত হয়। পার্টি চেয়ারম্যান পদ নিয়েও একই গেইম চলে। বিদ্রোহী গ্রুপ প্রকাশ্যে বেগম জিয়ার নাম ঘোষণা করলেও তাদের প্রার্থী ছিল ভিন্ন। এ ক্ষেত্রেও বিচারপতি সাত্তারের নির্দেশ ছিল, বেগম খালেদা জিয়া মনোনয়নপত্র জমা দিলে তার মনোনয়নপত্র যেন জমা দেওয়া না হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও তারা ব্যর্থ হয়। ওদের চালাকি বুঝতে পেরে বেগম জিয়া নিজেই ঘোষণা দেন যে, তিনি প্রার্থী নন। বিচারপতি সাত্তারই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। অত্যন্ত নিবিড়ভাবে সবকিছু দেখার ও শোনার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বিদ্রোহী গ্রুপ যদি বেগম জিয়ার ব্যাপারে আন্তরিক ও সৎ হতো, তিনিই শহীদ জিয়ার পর দেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হতেন, পার্টির চেয়ারপারসনও হতেন। মোট কথা, নেতৃত্বের দুগ্রুপের কেউই বেগম খালেদা জিয়াকে চাননি। তবে বেগম জিয়ার সৌভাগ্য বলতে হবে, তিনি নেতৃত্ব গ্রহণের পর অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী, মির্জা গোলাম হাফিজ, এস এ বারী এটি, জেনারেল মাজেদুল হক, কর্নেল (অব.) মুস্তাফিজুর রহমান, কে এম ওবায়দুর রহমান, আবদুস সালাম তালুকদার, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, শেখ রাজ্জাক আলী, কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ, আবদুর রহমান বিশ্বাস, আবদুল্লাহ আল নোমান, কবির হোসেন প্রমুখ প্রভাবশালী নেতার নিষ্ঠাপূর্ণ সমর্থন পেয়েছিলেন। অনেকেই বেগম জিয়ার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারতেন; প্রয়োজনে 'না' বলতে পারতেন।
এরশাদবিরোধী আন্দোলন শুরুর প্রাক্কালেই বিচারপতি সাত্তারের সঙ্গে থাকা গ্রুপের অধিকাংশ নেতা হুদা-মতিন-ভোলা মিঞার (এরশাদের মামা) নেতৃত্বে দল ভেঙে এরশাদের সঙ্গে চলে যায়। বিদ্রোহী গ্রুপের নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, শফিকুল গণি স্বপন প্রমুখও যোগ দেন স্বৈরাচার এরশাদের সঙ্গে। মতবিরোধের কারণে কে এম ওবায়দুর রহমানও দলত্যাগ করে নতুন দল গঠন করেন আহমদ নজির, রেজাবুদ্দৌলা চৌধুরী, শাহিনা খানদের নিয়ে। পরে তারা আবার ফিরে আসেন। এতসব টারময়েলের পরও এরশাদবিরোধী আন্দোলনে একঝাঁক দক্ষ 'মাঝি মাল্লার' সাহায্য-সহযোগিতায়ই বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতির সঠিক বন্দরে 'জাহাজ' নোঙর করতে পেরেছিলেন। দল ক্ষমতায়ও আসে। 'সহ-নাবিকরা' বেগম জিয়াকে শহীদ জিয়ার পথ থেকে স্খলিত হতে দেননি। আরও একটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, তখন দলে ও সরকারি কাজে তারেক রহমানের কোনো ভূমিকা ছিল না, ছিল না 'হাওয়া ভবন' বা 'গুলশান-বাজার কুটির'। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সাফল্যের পর সরকার গঠনে বিএনপিকে জামায়াত সমর্থন করেছে কিন্তু তাদের বাড়িতে-গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দেওয়া হয়নি।
ছিয়ানব্বইয়ের নির্বাচনে পরাজয়ের পর আবার নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় বিএনপির সামনে। প্রবীণ নেতাদের মধ্যে অনেকে মৃত্যুবরণ করেন, কেউ কেউ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। ব্যারিস্টার আবদুস সালাম তালুকদারের মৃত্যুর পর আবদুল মান্নান ভূঁইয়া দলের মহাসচিব নিযুক্ত হন। ১৯৯৭ সাল থেকেই দলে চরম দক্ষিণপন্থি প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। দলের ভিতর দলের জন্ম হয়। মিডিয়ায় একটি গ্রুপ নিজেদের জাহির করে 'কট্টরপন্থি' হিসেবে। মান্নান ভূঁইয়াকে বলা হয় 'নরমপন্থি', 'আপসকামী', ভারতের দালাল, কখনোবা সরকারের দালাল। দৈনিক ইনকিলাব হয়ে যায় তাদের 'মুখপত্র'। দুই 'জাতীয়তাবাদী বিদ্বান' পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠাজুড়ে তত্ত্ব দিতে থাকেন। মান্নান ভূঁইয়ার চৌদ্দগুষ্টির 'শ্রাদ্ধ' করে ছাড়েন তারা। ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে ৩ মাস অবিবেচকের মতো অবরোধ-হরতাল করে বেগম খালেদা জিয়া-তারেক রহমান যেমন সরকার ফেলে দিতে চেয়েছেন এবং চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন, ওই কট্টরপন্থিরাও তখন এমন একটি 'বিপ্লব' করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু একজন আবদুল মান্নান ভূঁইয়া তার দক্ষতায়, যোগ্যতায়, আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণের নিপুণ বিচক্ষণতায় ওদের বাড়াবাড়ি ঠেকিয়েছেন এবং বেগম জিয়ার নেতৃত্বে পরবর্তী নির্বাচনে দলকে 'জয়ের বন্দরে' পৌঁছাতে স্মরণীয় ভূমিকা রেখেছেন। স্বীকার করতে হবে, সেই নির্বাচনে (অষ্টম সংসদ) জয়ের পেছনে তারেক রহমানেরও যথেষ্ট অবদান ছিল। সেই নির্বাচনে বিএনপির এমন একটা পরিষ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল যে, জামায়াতিদের মন্ত্রিত্ব দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু যারা মান্নান ভূঁইয়াকে ছাঁটাই করে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী কিংবা খোন্দকার মোশাররফ হোসেনকে পার্টির মহাসচিব বানাতে চেয়েছিলেন, তারা ইতিমধ্যেই দলকে শহীদ জিয়ার পথ থেকে সরিয়ে একটি দক্ষিণপন্থি দলের কণ্টকিত সড়কে তুলে দিয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে দলটিকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। দলের এই স্খলন ঠেকাতে পারেননি মহাসচিব মান্নান ভূঁইয়া। বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান দলের দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীলদের দ্বারা খুবই প্রভাবিত ছিলেন। খুব ঠেকায় না পড়লে জিয়ার নামও তাদের মুখে উচ্চারিত হয়েছে কম। ওই গ্রুপটাই এখন দলে প্রভাবশালী।
জিয়াউর রহমান দল গঠন করেছিলেন এর মাধ্যমে দেশ ও জাতির স্বার্থ রক্ষার জন্য বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কালোত্তীর্ণ দর্শনের ভিত্তিকে দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদীদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য, একটি আত্মনির্ভরশীল সমৃদ্ধ দেশ গড়ার লক্ষ্যে। দলের ঘোষণাপত্রের শুরুতেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি ঘোষণা করেছেন অঙ্গীকার। আজীবন তিনি সৎ থেকেছেন, সততার আদর্শের আলো বিলিয়েছেন। তার সঙ্গে যারা কাজ করেছেন অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কর্নেল (অব.) অলি, মান্নান ভূঁইয়াদের মতো অনেকে ছিলেন- যাদের বিরুদ্ধে কখনো দুর্নীতির কোনো অভিযোগ শোনা যায়নি। দলে তিনি নতুন প্রাণের স্ফূরণ দেখতে চেয়েছেন। মন্ত্রী, এমপিদের দলের নেতা হতে দেননি। তাদের হাতে দলকে বন্দী করেননি। গণকল্যাণমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়নে চারণের বেশে ঘুরেছেন সারা দেশ। অসৎ দুর্নীতিবাজদের না প্রশ্রয় দিয়েছেন দলে, না দিয়েছেন সরকারে। আর এখন? শহীদ জিয়ার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে স্খলিত বিএনপি, জামায়াত তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার 'পঙ্খীরাজ'। তার সঙ্গে যারা কাজ করেছেন তাদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে শত সহস্র কোটি টাকার মালিক, বিভিন্ন ব্যাংক বীমা-করপোরেট হাউসের মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ, এত মামলা-মোকদ্দমা দুদকের, তারা এসব করেছেন এই বিএনপির আমলে। শহীদ জিয়ার আমলে দলের সুনির্দিষ্ট একটি কর্মসূচি ছিল ১৯ দফা তার মধ্যেও মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার পূরণের প্রত্যয় আছে। সেই অঙ্গীকারে অটল নেই বর্তমান বিএনপি। দল চালায় কর্মচারীরা। যাদের বিভিন্ন দলীয় পদে বসানো হয়, প্রয়োজনে নেত্রীর সঙ্গে দেখা করার জন্য ওই কর্মচারীদের কাছে গিয়ে তাদেরও হাত কচলাতে হয়। বিএনপিতে এখনো অনেক লোক আছেন যারা জিয়ার সময় থেকে দল করছেন। অনেক নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়ে আছেন যারা জিয়ার আদর্শ ধারণ ও লালন করছেন বুকে। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার আশপাশে যারা আছে তারা কবে থেকে বিএনপি করে? এরা কি বিএনপির আদর্শ ধারণ করে? সব তো চেনা মুখ। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, এরাই শহীদ জিয়ার প্রকৃত অনুসারীদের বেগম জিয়ার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। এমনকি বেগম জিয়া এবং দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যেও কৌশলে দেয়াল তুলে রেখেছে এরা। এসব বিষয় এখন আলোচনায় আসছে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব অধ্যাপক বি. চৌধুরী বেগম জিয়ার সামনে যথার্থই বিএনপিকে আত্ম-উপলব্ধি ও আত্ম-অনুসন্ধান করতে বলেছেন। এ জন্যই তো বলেছেন, বিএনপি বিএনপির জায়গায় নেই। আসল জায়গাটা খুঁজে নিতে হবে। তার এই বক্তব্যের সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন দলের প্রবীণ নেতা ও শহীদ জিয়ার সঙ্গী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। তিনি বলেছেন, 'এই' বিএনপি দিয়ে হবে না। তিনি বিএনপি দিয়ে হবে না বোঝাননি। বোঝাতে চেয়েছেন, বিএনপির বর্তমান অক্ষমতা ঘোচাতে হবে, যোগ্য ও সক্ষম বিএনপিই পারবে লক্ষ্য অর্জন করতে। এই অক্ষম বিএনপি পারবে না। তিনি এবং অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য বিএনপির অপরিহার্যতার কথাই বলেছেন প্রকারান্তরে।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, তারা যে বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, সেই বিএনপি চাইলে প্রথমে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কাগুজে ২০-দলীয় জোট ভেঙে দিয়ে নতুন কার্যকর জোট বিন্যাসের অর্থাৎ একটা গ্র্যান্ড ডেমোক্রেটিক এলায়েন্সের কথা ভাবতে হবে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টা স্পষ্ট করতে হবে। সাংগঠনিক প্রশ্নে সবার আগে গুলশান অফিসে তালা লাগিয়ে দিতে হবে এবার বেগম জিয়াকেই। এ অফিসটি এখন বিএনপির গলার কাঁটা। নয়াপল্টন অফিসে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে হবে, তরুণদের নেতৃত্বে আনতে হবে, ঢাকায় বসে জেলা ও থানার কমিটি বেচা-কেনা বন্ধ করতে হবে। দল পুনর্গঠনের কথা শোনা যাচ্ছে। দল আসলে পুনরুদ্ধার করতে হবে। পুরনো সব লোক খুঁজে বের করতে হবে, তাদের মর্যাদা দিতে হবে। নতুন-পুরানের সমন্বয় ঘটাতে হবে। ইদানীং পত্রপত্রিকায় ঘন ঘন লেখা হচ্ছে, সংস্কারপন্থিদের দলে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, তারা ক্ষমা চাইলে নাকি ফেরত নেওয়া হবে। কে কার কাছে ক্ষমা চাইবে? মান্নান ভূঁইয়ার উত্থাপিত সংস্কার প্রস্তাব তো ছিল দলের স্বার্থে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষাবলম্বন, গণতন্ত্র চর্চা, দুর্নীতিবাজদের বিতাড়ন, নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীকে মূল্যায়ন ও পরিবারতন্ত্র পরিহার- এ সবই ছিল সংস্কার প্রস্তাবের প্রতিপাদ্য। এখন তো জিয়ার বিএনপি পুনরুদ্ধারে এসবই প্রয়োজন জরুরিভাবে। সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপনকারীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে অন্যায় তো করেছেন দলীয় নেতৃত্ব। তাদেরই না দুঃখ প্রকাশ করার কথা। সংস্কারপন্থিদের মধ্যে যারা দল থেকে সুবিধা ভোগের কথা ভাবেন, দলে যারা বসন্তের কোকিল, বেগম জিয়ার আমলের শেষ দিকে যারা বিএনপি চিনেছেন, তারা পদলেহন করে হলেও দলে ঢোকার জন্য উন্মাদ হয়ে যেতে পারেন, কিন্তু যারা আদর্শবাদী, বারবার ক্ষমতার সঙ্গে থেকেও কোনো সুবিধা নেননি এবং যারা শহীদ জিয়ার প্রকৃত অনুসারী তারা অবিচারকারীদের কাছে ক্ষমা চাইবে কেন? মনে রাখা দরকার, রাজনীতিতে আত্মমর্যাদাহীন, পদলেহনকারীরা কোনো উপকারে আসে না। এটাও ওই দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের 'পেইড এজেন্টদের কারসাজি কিনা কে জানে! দলে যাদের প্রয়োজন, আবার দল যাদের প্রাণ, তাদের দলে নিতে হবে সম্মানের সঙ্গে। আবর্জনা সাফ করে এদের যোগ্য স্থান দেওয়া দরকার দলের স্বার্থেই।
মান্নান ভূঁইয়ার অনুসারী সংস্কারপন্থিরা দলের বোঝা নয়, সম্পদ হিসাবে বিবেচিত হতে পারেন। বিএনপির ওপর থেকে নিচে সারা দেশে মান্নান ভূঁইয়ার নীরব অনুসারীর সংখ্যা বিপুল। দলের নেতারা তাদের হয়তো চেনেনই না। মান্নান ভূঁইয়ার প্রতি অবমাননায় এদের হৃদয়ে এখনো রক্তক্ষরণ হয়। এই কর্মী-শক্তিই বেশি প্রয়োজন এখন দলের। মান্নান ভূঁইয়ার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে, তাকে মরণোত্তর দলীয় সম্মান দিয়ে তার অনুরাগীদের আবার প্রাণোচ্ছল করা যায়। বেগম জিয়ার দলে মান্নান ভূঁইয়ার দীর্ঘদিনের অবদানের কথা মনে করেও কি একবার 'সরি' বলতে পারেন না? এতে তো তার হৃদয়ের বিশালতাই প্রমাণিত হবে। তিনি যদি একবার মান্নান ভূঁইয়ার কবর জিয়ারত করতে যান, তাতে সর্বত্র এই বার্তাটাও তো পৌঁছে যেতে পারে, বিএনপি চরম ডানপন্থিদের ত্যাগ করেছে বা করছে। দেশে-বিদেশে এতে দলের প্রকৃত ঐক্যের বার্তা যাবে এবং দলের মর্যাদা বেড়ে যাবে অনেক। সরকারি অপপ্রচারও তখন মুখ-থুবড়ে পড়বে। বাম প্রগতিশীল ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণের দুয়ারও খুলে যাবে। সেই উপযুক্ত পরিবেশে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ, শেখ রাজ্জাক আলীদেরও দলে ফেরার আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
ই-মেইল : [email protected]