চার দশকেরও বেশি সময় ধরে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প বিশ্বব্যাপী এক সম্মানজনক অবস্থানে পৌঁছেছে। ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগটি এখন পৃথিবীজুড়ে সুপরিচিত। ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশে পোশাকশিল্পের যাত্রা শুরু হয়। আজ বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ।
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান খাত হিসেবে পোশাকশিল্পের এই অসামান্য অগ্রগতি একদিকে যেমন দেশের জন্য গর্বের বিষয়, তেমনি এর প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখাও আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
বিগত বছরগুলোতে পোশাকশিল্পের এই প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়ন দেখে এটা মনে হতে পারে যে বাংলাদেশের পোশাক খাত একটি ভালো অবস্থানে রয়েছে। এটি বাস্তব যে নানা ঝঞ্ঝা এবং প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়েও পোশাকশিল্প একের পর এক বাধা অতিক্রম করে তার প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। তবে পোশাকশিল্পের এই প্রবৃদ্ধি শিল্পের প্রকৃত অবস্থার প্রতিফলন নয়। বাস্তবে পোশাকশিল্প নানাবিধ সমস্যা এবং চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।
উৎপাদন খরচের বৃদ্ধি পোশাকশিল্পের একটি বিশাল সমস্যা। গত পাঁচ বছরে পোশাকের গড় উৎপাদন খরচ প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। বিশেষভাবে জানুয়ারি ২০২৪ থেকে ন্যূনতম মজুরি ৫৬ শতাংশ বেড়েছে, যা সরাসরি উৎপাদন খরচকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া বিদ্যুতের মূল্য বেড়েছে ৩৩ শতাংশ, গ্যাসের মূল্য বেড়েছে ২৮৬ শতাংশ এবং ডিজেলের মূল্য বেড়েছে ৬৪ শতাংশ। এসব কারণে পরিবহন খরচসহ সার্বিক উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। এই খরচ বৃদ্ধি শুধু শিল্পের প্রতিযোগিতার সক্ষমতায় প্রভাব ফেলছে তা নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পোশাক খাতের অবস্থানকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে।
কয়েক বছর ধরে পোশাক কারখানাগুলোতে গ্যাস সরবরাহে সমস্যা হচ্ছে। তাতে কারখানাগুলোতে কাজ থামিয়ে রাখতে হচ্ছে। তা ছাড়া অনেক কারখানাকে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ডিজেল ব্যবহার করে উৎপাদনব্যবস্থা চালিয়ে যেতে হয়। এতে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে কারখানাগুলোর পক্ষে উৎপাদন ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা সম্ভবপর হবে না। এতে পোশাক রপ্তানির ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিল্পগুলোতে পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কারখানাগুলো তার সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার করে উৎপাদন কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে পারে।
বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাংকঋণের সুদের হার ১৪ শতাংশ-১৫ শতাংশ, যা ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। পোশাক খাতে যারা ঋণ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন, তাদের জন্য উচ্চ সুদের হার একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। উচ্চ সুদের ফলে ব্যাবসায়িক খরচ বাড়ছে, আর্থিক খাতে অনিশ্চয়তা বাড়ছে এবং ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া আরো কঠিন হয়ে পড়ছে। ফলে এই খাতে নতুন বিনিয়োগ নিরুৎসাহ ও বাধাগ্রস্ত হবে, যা শিল্পের প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করবে।
বাংলাদেশের এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ পোশাকশিল্পের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ বর্তমানে এলডিসি সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য দেশে শুল্কছাড় পেয়ে থাকে। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর এসব সুবিধা বাতিল হয়ে যাবে। এর ফলে পোশাকশিল্পের রপ্তানি খরচ বৃদ্ধি পাবে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা করা আরো কঠিন হয়ে পড়বে। বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকায় আরো উচ্চ শুল্ক আরোপিত হলে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের জন্য বাজার ধরে রাখা কঠিন হবে।
পোশাকশিল্পের সামনে বহুমুখী চ্যালেঞ্জশিল্প যখন নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, এমন অবস্থায় আন্তর্জাতিক বাজারে পোশাকের দরপতন পোশাকশিল্পের ওপর তৈরি করেছে এক বিশাল চাপ। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের প্রধান রপ্তানি বাজার ইউরোপ ও আমেরিকা। ইউরোস্ট্যাটের তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়কালে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির মূল্য ৪.৮৯ শতাংশ কমে গেছে। একই সময়ে ইউরোপে দরপতন হয়েছে ৫.২২ শতাংশ। ইউরোপ ও আমেরিকার মতো বড় বাজারে বাংলাদেশের পোশাকের দাম কমে যাওয়ার ফলে রপ্তানি থেকে লাভ কমছে। এর ফলে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি আর লাভ কমে যাওয়া নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশের পোশাকশিল্প যখন এমন একটি চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেই সময় নগদ প্রণোদনা প্রত্যাহারের মতো নীতি সহায়তা প্রত্যাহারসহ বিভিন্ন বিষয় এ খাতের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হলে এ শিল্পকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। বিকল্প ব্যবস্থা না করে হঠাৎ প্রচলিত নীতি সহায়তার পরিবর্তন শিল্প ও অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত ২০০৪ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তীর্ণ হলেও তারা তাদের টেক্সটাইল খাতকে এখনো নগদ সহায়তার পরিবর্তে নানাবিধ বিকল্প নীতি সহায়তা ও প্রণোদনা প্রদান করছে। অথচ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের কথা বলে আমাদের দেশে নগদ সহায়তা কমানো হয়েছে। কাজেই আমাদের আগে বিকল্প প্রণোদনার ব্যবস্থা করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যাতে আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের পোশাকশিল্পে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বজায় থাকে।
বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের সামনে যেমন অনেক চ্যালেঞ্জ আছে, তেমনি রয়েছে সমৃদ্ধির বিশাল সম্ভাবনা। যদি সরকার শিল্পের এই সমস্যাগুলোর প্রতি যথাযথ মনোযোগ দেয় এবং সেগুলো মোকাবেলার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তবে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প বিশ্ববাজারে তার অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করতে পারবে এবং দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অধিকতর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
লেখক : ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ট্রেড গ্রুপ ও সাবেক পরিচালক, বিজিএমইএ
বিডি প্রতিদিন/আশিক