বাংলাদেশে উচ্চতর শিক্ষা শেষে পিএইচডি করেন জাপানে। এরপর ছুটে আসেন যুক্তরাষ্ট্রে স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটাতে। কিন্তু সেটি অধরাই থেকে যাচ্ছিল। ‘অড জব’ দিয়ে শুরু প্রবাস জীবনের। সবকিছু এলোমেলো হচ্ছিল। হতাশার সাগরে হাবুডুবু খাওয়ার মধ্যেই ‘পিপল এন টেক’র কথা শুনলেন ড. শফিউল হামিদ। ৪ মাসের কোর্স নিয়ে ঢুকে পড়েছেন আইটি সেক্টরে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পরবর্তীতে বাংলাদেশ থেকে আসা উচ্চ শিক্ষিত স্ত্রী নাসরিন সুলতানাকেও পিপল এন টেক’র কোর্স নিতে বলেন। সে অনুযায়ী স্বামী-স্ত্রী উভয়েই এখন মোটা আয়ের চাকরি করছেন মার্কিন আইটি সেক্টরে। আনন্দে কাটছে তাদের জীবন। এমনি অনেক প্রবাসীর স্বপ্নের সারথীর অজানা তথ্য উপস্থাপিত হলো ২৩ অক্টোবর রবিবার নিউইয়র্কে ‘পিপল এন টেক’ থেকে গত ১৮ বছরে কোর্স গ্রহণের পর বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত এলামনাইরা। এটি ছিল এই সংস্থার সাবেক শিক্ষার্থীদের প্রথম একটি উৎসব। দিনভর বৃষ্টি ঝরলেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক এলামনাই সপরিবারে এসেছিলেন বিভিন্ন সিটি থেকে।
ক্যাসিনো সিটি হিসেবে বিশ্বখ্যাত আটলান্টিক সিটি মন্দায় গ্রাস করলে কর্মহীন হয়ে পড়েছিলেন উচ্চশিক্ষিতা ফাতেমা ইয়াসমীন। ২০১৩ সালের ঘটনা। সেখানে ‘পিপল এন চেক’র ক্যাম্পাস চালু করা হয়। ফাতেমা ছুটে যান এবং কোর্সগ্রহণ করেন। চাকরিও জুটে যায় সাউথ ক্যারোলিনায়। এখনও সে চাকরিতেই রয়েছেন এবং আর্থিক স্বচ্ছ্বলতার প্রত্যাশাও পূরণ হয়েছে বলে উল্লেখ করলেন এই সামিটে।
পিপল এন টেক’র ভূমিকার প্রশংসাকালে মীর হোসেন বললেন, কুমিল্লা বোর্ডে আমি প্রথম স্থান নিয়ে এসএসসি করার পর খ্যাতনামা কলেজ পেরিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে আমেরিকায় এসেও ‘অড জব’ করতে বাধ্য হই। এক পর্যায়ে প্রিয়-পরিচিতজনের মাধ্যমে পিপল এন টেক’র সান্নিধ্যে এসে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলোর বাস্তবায়নের সুযোগ তৈরী হয়েছে। মীর হোসেন বর্তমানে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি মন্ত্রণালয়ে আইটি স্পেশালিস্ট হিসেবে চাকরির পাশাপাশি আটলান্টিক সিটিতে পিপল এন টেক’র ক্যাম্পাসে শিক্ষকতা করছেন।
এ সামিটে সকলে এসেছিলেন তাদের সাফল্যের গল্প শোনাতে। তারা শুনিয়েছেন মাত্র চার মাসের একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি কিভাবে তাদের জীবনকে বদলে দিয়েছে। তারা বলেছেন, তাদের নিজের কেবল নয়, বদলে গেছে তাদের পরিবারের চালচিত্র। আর সর্বোপরি তারা গড়ে তুলতে পারছেন একটি যোগ্য ভবিষ্যত প্রজন্ম। যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারায় তারা একেকজন এখন দক্ষ আইটি প্রফেশনাল। তাদের কেউ আইটি প্রজেক্ট ম্যানেজার, কেউবা প্রজেক্ট লিডার। আবার কেউ কেউ নিজেই এখন প্রশিক্ষক-শিক্ষক।
আয়োজনের মধ্যমনি ছিলেন পিপলএনটেক’র (People N Tech )প্রতিষ্ঠাতা-সিইও এবং ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির চ্যান্সেলর আবুবকর হানিপ। ছিলেন পিপলএনটেক’র প্রেসিডেন্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএফও ফারহানা হানিপ। আর তাদের ঘিরে ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির নিউইয়র্ক, ভার্জিনিয়া, নিউজার্সি, পেনসিলভেনিয়া কার্যালয়ের সকল কর্মকর্তা। তবে আয়োজনের মূল আকর্ষণ ছিলেন সেইসব অ্যালাম যাদের গল্প মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেছেন উপস্থিত সকলে।
নিউইয়র্ক অঞ্চলের বিশিষ্টজনেরা এতে নিমন্ত্রিত ছিলেন। ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারাও। প্রধান অতিথি ছিলেন নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল ড. মনিরুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি ছিলেন আরটিভি'র সিইও সৈয়দ আশিকুর রহমান। আরো ছিলেন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রধানরা।
অ্যালামনাইদের একেকটি গল্পই ছিলো ইউনিক। তারা যেমন নিজেদের এগিয়ে চলার কথা শুনিয়েছেন তেমনি শুনিয়েছেন, পিপলএনটেক তাদের জীবন গড়ে দিতে ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
তারা বলছিলেন প্রশিক্ষকদের কথা। যাদের প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা নিজেরাই এখন একেকজন প্রশিক্ষক। তারা বলছিলেন পিপলএনটেকের প্রেসিডেন্ট ফারহানা হানিপের কথা। যিনি সকল প্রচেষ্টায় পিপলএনটেককে সামনে এগিয়ে নিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
আর ইঞ্জিনিয়ার আবুবকর হানিপ তাদের শোনান তার নিজের জীবনের গল্পটিও। দেশে স্বনামধন্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে এদেশে পড়তে এসে কিভাবে একটি সংগ্রামময় সময় পার করে নিজেকে এই আইটি খাতে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। আবুবকর হানিপের সে গল্প সকলের জন্যই অনুপ্রেরণার।
হানিপ বলেন, নিজে দু’লাখ ডলার বেতনের চাকরি করতেন যুক্তরাষ্ট্রে সুপ্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানে কিন্তু ভেবেছিলেন একার উন্নতি শুধু নয়, আরও মানুষ যাতে এইভাবে তাদের জীবনটিকে পাল্টে দিতে পারে সেই প্রচেষ্টাই তাকে নিতে হবে। আর সেই ভাবনা থেকেই পিপলএনটেক প্রতিষ্ঠা করেন।
হানিপ জানান, বাংলাদেশি কমিউনিটির মানুষগুলোকে এদেশে সংগ্রামের জীবন থেকে বের করে এনে সুন্দর জীবন দেওয়ার ব্রত তিনি নিয়েছিলেন ১৮ বছর আগে ২০০৪ সালে। শুরুটা হয় মাত্র একজন ছাত্র দিয়ে। সেই ছাত্রটি কোর্স সম্পন্নের পর যখন পেয়ে গেলেন মূলধারায় মোটা মাইনের চাকরি... এরপর আরও ছাত্র আসতে থাকে। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ধীরে ধীরে পিপল এন টেকের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। আর এই সময়ের মধ্যে ৭ হাজারের বেশি বাংলাদেশিকে আইটি প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত করে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ধারায় কাজ পাইয়ে দিয়েছে পিপলএনটেক। যারা এখন স্বাচ্ছন্দের জীবন যাপন করছেন। আর গড়ে তুলছেন নিজেদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে। রেমিট্যান্স পাঠিয়ে ভূমিকা রাখতে পারছেন বাংলাদেশের অগ্রগতিতেও।
হানিপ এক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে জানান, প্রতি বছর পিপলএনটেকের মাধ্যমে চাকরিতে প্রবেশকারিরা ১৬শত কোটি টাকা করে পাঠাচ্ছেন বাংলাদেশে স্বজনের কাছে। অর্থাৎ প্রথম প্রজন্মের এসব প্রবাসীর স্বজনের সিংহভাগই এখনও বাংলাদেশেই বাস করছেন। হানিপ বললেন, বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও বাস্তবতা এই যে, এদেশে জন্ম অথবা বেড়ে উঠা দ্বিতীয় প্রজন্মের অনেকে নামকরা ভার্সিটি থেকে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণ করেও চাকরি না পেয়ে পিপলএনটেকে আসছে এবং চার মাসের কোর্স সম্পন্নের পরই উচ্চ বেতনের চাকরি লাভে সক্ষম হচ্ছেন। এভাবেই পিপলএনটেক এখন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের কর্মসংস্থানের নির্ভরযোগ্য একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে।
উপস্থিত সকলকে তন্ময় করে রাখা বক্তৃতায় আবুবকর হানিপ বর্তমানে তার পরিচালিত ‘ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’র (ডব্লিউইউএসটি)কথা তুলে ধরে বলেন, এটি পিপলএনটেকেরই একটি ধারাবাহিকতা এবং তার দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্নপূরণ। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি কমিউনিটিকে মূলধারায় এগিয়ে নিতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি একটি দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে পরিচালিত। এখানকার শিক্ষকরা একাধারে স্কলার ও ইন্ডাস্ট্রি থেকে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। ইন্ডাস্ট্রি থেকে তাদের লব্দ অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা তারা নিয়ে আসছেন শ্রেণিকক্ষে। এবং তার মাধ্যমে শিক্ষাদানের কারণে শিক্ষার্থীরা দক্ষ হয়েই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কর্মজগতের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
এই ভার্সিটির শিক্ষার্থীরাও পিপলএনটেকের প্রশিক্ষণার্থীদের মতো মূলধারায় বড় বড় কাজে যোগ দিতে শুরু করেছেন। একসময় ডব্লিউইউএসটির অ্যালামনাইরা এদেশের ফরচুন হান্ড্রেড কোম্পানির উচ্চপদে আসীন হবে এই প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেন ইঞ্জিনিয়ার আবুবকর হানিপ। এবং বলেন, এটাই তার লক্ষ্য।
পিপলএনটেকের প্রেসিডেন্ট ফারহানা হানিপ বলেন, আজ আমরা আমাদের এলামনাইদের সাফল্যকেই উদযাপন করতে চাই। অ্যালামনাই এখন আর ক্যাম্পাসে নেই কিন্তু তারা সকলেই আমাদের অন্তরে রয়েছেন। কেউ কেউ এখন উচ্চ পর্যায়ে উঠেছেন, তাদের এই অর্জনে আমরা গর্বিত।
ডব্লিউইউএসটিকে সফল করে তুলতে পিপলএনটেকের অ্যালামনাইদের পাশে থাকার আহবান জানান তিনি। কমিউনিটির পক্ষ থেকে পাওয়া অব্যহত সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানান ফারহানা হানিপ। বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানান গণমাধ্যমসমূহের আন্তরিক সহযোগিতাকে।
পিপলএনটেকের সফল অ্যালামনাইদের অভিনন্দন জানিয়ে প্রধান অতিথি ড. মনিরুল ইসলাম বলেন, আপনাদের সাফল্য আমাদের মুগ্ধ করে এবং বাংলাদেশীদেরকে গৌরবান্বিত করে।
আবুবকর হানিপ একটি উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন এমনটা উল্লেখ করে তিনি বলেন, তিনি মানুষকে দিতে পছন্দ করেন। তিনি মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, শিক্ষাদান করছেন এবং একই সঙ্গে তাদের কাজ দিতে সব ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন। অপরকে দেওয়ার এই মানসিকতাই তাকে এমন একটি উচ্চতায় নিয়ে গেছে যে, সকলেই তার জন্য গৌরববোধ করেন।
বাংলাদেশি ডায়াসপোরার অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রে তাদের পদচিহ্ন রাখতে সক্ষম হয়েছেন। আবুবকর হানিপ তাদের অন্যতম একজন, বলেন কন্সাল জেনারেল ড. মনিরুল ইসলাম।
বিশেষ অতিথি সৈয়দ আশিকুর রহমান পিপলএনটেকের এই সাফল্যের প্রশংসা করে বলেন, এমন একটি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিকে সামনে এগিয়ে নিতে আবুবকর হানিপ ও ফারহানা হানিপ যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তা অনুসরনীয়।
সংস্থাটির পরিচালক ড. শফি চৌধুরীর পরিচালনায় এ অনুষ্ঠানে অতিথির মধ্যে মোহাম্মদ এন মজুমদার এবং কম্যুনিটি লিডার সৈয়দ মোস্তফা আল আমিন রাসেলও বক্তব্য রাখেন।
পরে সফল অ্যালামনাইদের হাতে শুভেচ্ছা স্মারক হিসেবে ক্রেস্ট ও ফুলের তোড়া উপহার দেওয়া হয়। এরপর পিপলএনটেকের সকল কর্মকর্তাকেও তুলে দেওয়া হয় ক্রেস্ট ও ফুলের তোড়া। আবুবকর হানিপ ও ফারহানা হানিপকেও জানানো হয় বিশেষ সম্মাননা। আর সবশেষে বিশেষ অতিথি ও প্রধান অতিথিকে ক্রেস্ট তুলে দেন ইঞ্জিনিয়ার আবুবকর হানিপ।
জাপানে পিএইচডি শেষে যুক্তরাষ্ট্রে এসেও অডজবে লিপ্ত হওয়া ড. শফিউল হামিদ দম্পতি পিপলএনটেকের মাধ্যমে মার্কিন আইটি সেক্টরে মোটা বেতনের চাকরি করছেন। তাদেরকেও বিশেষ সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করা হয় অ্যলামনাই সামিটে।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন